বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০০৮

পরিবেশবান্ধব সবুজ সার


পরিবেশবান্ধব সবুজ সার


কোন কোন বিশেষ ফসল চাষ করে তা নির্দিষ্ট বয়সে ভূমি উন্নয়নকল্পে চাষ দিয়ে মাটির সাথে মিশিয়ে দিলে তাকে সবুজ সার বলা হয়। যে কোন সবুজ গাছকে কোমল অবস্থায় মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া, মাটির গুণাবলী উন্নয়নের জন্য একটি উত্তম কাজ বলে প্রাচীনকাল থেকেই স্বীকৃত হয়ে আসছে। মিশিয়ে দেয়ার পর মাটিতে অবস্থানরত অনুজীবের কার্যাবলীতে বিয়োজন ঘটে এবং এগুলো জৈব সারে পরিণত হয়। গাছের সবুজ পাতা, কচি শাখা-প্রশাখা সংগ্রহ ও জমিতে প্রয়োগ করে যে সার উৎপাদন করা হয় তাকে সবুজ পাতা সার বলে। জমির আশপাশ, পতিত জমি ও জঙ্গল থেকে পাতা ও শাখা সংগ্রহ করা যায়। জমিতে চাষ দিয়ে মিশিয়ে দেয়ার পর তার পচন প্রকৃতি ও পচন হারের উপর সবুজ সারের কার্যকরিতা নির্ভর করে। জমিতে মিশিয়ে দেয়ার পর সবুজ দ্রব্য পর্যায়ে কয়েকটি জৈব রাসায়নিক সার বিক্রিয়া সংঘটিত হয়। এসব বিক্রিয়ার পর সার থেকে খাদ্যোপাদান ধীরে ধীরে উদি্‌ভদের জন্য প্রাপ্য হয়ে ওঠে। এজন্য অন্যান্য আয়তনী জৈব সারের চেয়ে সবুজ সারের কার্যকারিতা কিছুটা ধীরে বা বিলম্বিত হয়। সবুজ সারের পচনহার এবং মাধ্যমিক যৌগ উৎপাদন নিম্নলিখিত উপাদানের উপর নির্ভর করেঃ

উপস্থিত অণুজীবের প্রকারঃ মাটিতে উপস্থিত অণুজীবের প্রকার ও কার্যপদ্ধতি যেমন ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের সংখ্যা, স্বভোজী ও অন্যভোজী অণুজীবের সংখ্যা, সবাত অণুজীবের সংখ্যা ইত্যাদি সবুজ পচন হার নির্ধারিত করে।

উত্তাপঃ সবুজ সারের পচনের জন্য ৩০ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সে· তাপ সবচেয়ে ভাল। কম বা বেশি তাপে পচন হার কমে।

বায়ু চলাচলঃ মাটিতে বায়ু চলাচল পচন হার বাড়ায়।

সবুজ সারের জন্য মনোনীত গাছের বয়স বাড়ার সাথে সাথে সবুজ সারের মোট পরিমাণ এবং জমিতে পচনশীলতা বা পচন হারও ভিন্ন হয়। সবুজ গাছের বয়সভেদে এর রাসায়নিক গঠন ও উপাদানের পরিমাণে পার্থক্য হতে থাকে। এজন্য একটি নির্দিষ্ট বয়সের গাছ দিয়ে সার উৎপাদন করলে অধিক সুফল পাওয়া যায়। গাছের চারা বয়সে সহজে বিয়োজনযোগ্য নাইট্রোজেন পরিমাণে বেশি থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সেলুলোজ ও লিগিনিনেন পরিমাণ বেড়ে গেলে গাছ পচতে অসুবিধা হয় বা বিলম্ব হয়। মাটির কার্বন ও নাইট্রোজেন অনুপাত বেড়ে যায়। গাছের বয়স বাড়ার সাথে পেন্টোসান দ্রব্যের পরিমাণও বেড়ে যায়। অবশ্য গাছের বয়স খুব কম হলে সেখানে পানি ও পানিতে দ্রবণীয় দ্রব্য বেশি থাকে বলে সবুজ সার হিসেবে এর স্থায়িত্ব ও কার্যকারিতা কম হয়।

জমিতে সবুজ সার ব্যবহার করলে খুব উপকার পাওয়া যায়। যেমনঃ ১· মাটির উর্বরতা শক্তি বাড়ে ২· মাটির উৎপাদন বাড়ে ৩· মাটিতে জৈব পদার্থের পরিমাণ বাড়ে ৪· মাটির ভৌত অবস্থার উন্নয়ন হয়, বিশেষ করে, মাটির সংযুক্তি উন্নয়ন সাধন ৬· মাটির আচ্ছাদিত রেখে ক্ষয় কমে ৭· মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়ে ৯· মাটিতে জীব ও অনুজীবের কার্যাবলী বাড়ে ১০· ফসল উৎপাদনের রাসায়নিক সারের কার্যকারিতা বাড়ে ১১· মাটি নরম রাখে।

যেকোন ফসল বা লতাপাতা সবুজ অবস্থায় মাটিতে মিশিয়ে দিলে তা থেকে সবুজ সারের কিছু না কিছু উপকারিতা পাওয়া যায়। কিন্তু কতকগুলো বিশেষ গুণাবলীসম্পন্ন ফসল বা গাছ দিয়ে সবুজ সার করলে অনেক বেশি উপকার পাওয়া যায়।

বাংলাদেশের জলবায়ু ও মাটির উর্বরতার বিবেচনায় নিম্নলিখিত উদি্‌ভদসমূহকে সবুজ ফসল হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। যথাঃ ধৈঞ্চা, গো-মটর, শন, বরবটি, সিম, আলফালফা, ক্লোভার, লুসার্ন প্রভৃতি। দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল কাউপি বা গো-মোটর দিয়ে সবুজ সার করার সম্ভবনা খুবই উজ্জ্বল। চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগে বিপুল পরিমাণ জমিতে গো-মটরের চাষ হয়।

যে সম- জমি বেলেপ্রধান এবং জমিতে পানি জমার আশংকা নেই সেখানে সবুজ সার ফসল হিসেবে শন, পাট উপযোগী। এর শারীরিক বৃদ্ধ দ্রুত। মাটিতে এটি দ্রুত বিয়োজিত হয়। ধৈঞ্চা কিছুটা কষ্ট সহিষ্ণু উদি্‌ভদ, এঁটেলজাতীয় মাটিতে ভাল জন্মে। ধৈঞ্চা কিছুটা খরা ও অপরদিকে জলবদ্ধতা সহ্য করতে পারে। বাংলাদেশে জলাবদ্ধ জমিতে সবুজ ফসল হিসেবে তুলনামূলকভাবে বেশি উপযোগী।

ধৈঞ্চা সবুজ সারকরণ ও বীজ উৎপাদনঃ বাংলাদেশে সবুজ সার উৎপাদনের জন্য ধৈঞ্চা উপযুক্ত। তবে বেলেজাতীয় মাটির জন্য শন ভাল। বছরের যে কোন সময়ে মাটির জোঁ অবস্থায় ঘন করে বীজ বুনে দিলে ৪০ থেকে ৫০ দিনের মধ্যে সবুজ সার উৎপাদন করা যায়। আমাদের দেশে বর্তমানে দুই ধরনের ধৈঞ্চা গাছ দেখা যায়। যথা- ১· সাধারণ ধৈঞ্চা, ২· আফ্রিকান ধৈঞ্চা।

মাটির প্রতিকূল অবস্থার কারণে মূল জমিতে বীজ বুনা সম্ভব না হলে অন্যত্র চারা তুলেও তা পরবর্তী সময়ে রোপণ করা যায়। বীজতলায় চারা উৎপাদনের জন্য প্রতিশতক জমিতে ৩০০ গ্রাম বীজ বুনতে হবে। বীজ থেকে চারা হলে তা সরাসরি লাগানো যায় আবার চারা একটু বড় হলে কাটিং করেও লাগানো যায়।

সবুজ সার উৎপাদনী ফসলের মধ্যে মাসকলাই ও মুগ কলাইয়ে নাইট্রোজেনের পরিমাণ ধৈঞ্চর চেয়ে কিছুটা বেশি, তবে ধৈঞ্চায় মোট সবুজ দ্রব্যের পরিমাণ বেশি। এসব গাছে ফসফেটের পরিমাণ প্রায় নাইট্রোজেনের সমান। পটাসের পরিমাণ ধৈঞ্চা গাছে একটু বেশি। আমাদের দেশে সবুজ সার হিসেবে ধৈঞ্চা গো-মটর ও শন-পাটের ব্যবহার অধিক লাভজনক। মাস কলাই ও মুগ কলাই সাধারণত সবুজ সার ফসল হিসেবে ব্যবহৃত হয় না। তবে ফসল হিসেবে চাষ করলে আংশিক উপকার হয়।

সবুজ ফসল হিসেবে ধৈঞ্চা গাছের একটি বিশেষ সুবিধা হচ্ছে এটি জলাবদ্ধ এবং অনুর্বর জামিতেও জন্মে। ধৈঞ্চার বীজ উৎপাদন হারও বেশি। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গো-মটর, মুগ, মাসকলাই, সয়াবিন বরবটি ইত্যাদি। সবুজ সার ফলস হিসেবে ব্যবহার না করলেও তা পরিপক্ক হওয়ার পর মাটির উপরের অংশ কাচি দিয়ে কেটে নিলে নডিউল ও শিকড় মাটিতে থেকে গিয়ে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে।
- প্রফেসর ড· মোঃ সদরুল আমিন

কোন মন্তব্য নেই: