রবিবার, ৭ ডিসেম্বর, ২০০৮

আঞ্চলিক কৃষির বিকল্প নেই



আঞ্চলিক কৃষির বিকল্প নেই


২০০৮ সালের শুরুতেই জানা গেল, পৃথিবীর ৩৩টি দেশে খাদ্যের তীব্র সংকট চলছে। তারমধ্যে বাংলাদেশের নামও ছিল। দেশ স্বাধীনের পরে গবেষণাধর্মী উন্নত জাতের ধান আবিষ্কার ও তাতে উন্নত সার-কীটনাশকের ব্যবহার করে মাঠে মাঠে সোনালি ধানের উৎপাদন শুরু করা হয়। বর্তমান ১৫ কোটি মানুষের জন্য যে ৩ কোটি মেঃ টন ফসলের উৎপাদন করা হচ্ছে তাতেও আমরা আমাদের অভাব দূর করতে পারছি না। কেননা প্রতি বছর প্রায় ২৫ লক্ষ বাড়তি মানুষ আর উৎপাদিত জমি হারাচ্ছি। যে জন্য যতই উচ্চ ফলনশীল জাতের ফসল আসুক না কেন অভাব আমাদের সাথের সাথী। যখন আমাদের দেশে ২০ কোটি মানুষের বাস হবে তখন খাদ্যের প্রয়োজন হবে ৩·৬৪ কোটি মেঃ টন। এখন প্রতি হেক্টরে ধানের উৎপাদন ফলন ৩·৩ থেকে ৪·০ মেঃ টন, বাড়তি এ মানুষের কারণে ওই পরিমাণ জমিতে খাদ্য উৎপাদনের প্রয়োজন হবে ৪·৪ থেকে ৫·৩ মেঃ টন। অথচ প্রতি বছর বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও অন্যান্য কারণে আবাদি জমি কমে আসছে। সে জন্য দেশের নিশ্চিত খাদ্য নিরাপত্তার জন্য অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি অঞ্চল ভিত্তিক অনুকূল আবহাওয়ায় কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে নজর দিতে হবে।

দিনাজপুর ধান উৎপাদনের স্বর্গভূমি। সেখানে প্রতি ইঞ্চি জমির ব্যবহার করে ধান উৎপাদন করা যায়। যশোর ও নরসিংদিতে সবজি-কলা ভাল হয়। এখানে সম্পূর্ণ জমির ব্যবহার করে এই ফসল বাড়াতে হবে। কুমিল্ল্লায় এক জমিতে বছরে অনেকবার ফসল উৎপাদন হয়ে থাকে। দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষি জমিতে বছরে ২টি ফসল ফলানো সম্ভব। অথচ এখানে যে বিশাল কৃষিক্ষেত্র অনুউৎপাদন অবস্থায় থাকে, তা গরিব এ জাতির জন্য অভিশাপ। এ অঞ্চলে সাথী ফসল ও আইল ফসল চাষের উদ্যোগ গ্রহণ করা যেতে পারে। লাগসই প্রযুক্তির মাধ্যমে মঙ্গাপ্রবণ এলাকাতে কৃষি জমির পরিপূর্ণ ব্যবহার করলে অর্থনীতিতে তা আর্শীবাদ হয়ে কাজ করবে। মুন্সিগঞ্জ জেলাতে উর্বর যে জমি রয়েছে তাতে আলু উৎপাদনের পরেই বিনা চাষে ভুট্টোর আবাদ করলে ভাল হয়। দক্ষিণাঞ্চলে রয়েছে আমাদের দেশের তরল সম্পদের সমারহ। জল ও মাটির লবণাক্ততাকে সাথে নিয়ে এখানকার কৃষকেরা যে চাষাবাদ পদ্ধতির নিমন্ত্রণ জানিয়েছে, তাকে আরও বি-ৃতি ঘটানোর জন্য পদক্ষেপ নেয়া না গেলে দেশের সম্পদ ব্যবহারে পরিপূর্ণতা আসবে না। পার্বত্য অঞ্চল আমাদের দেশের মোট জমির শতকরা ১২ ভাগ নিয়ে গঠিত। গত বোরো মৌসুমে এখানকার সমতল ভূমিতে বাঙালিরা অনেক ধান উৎপাদন করে। মালয়েশিয়াতে পাহাড়ে পাম চাষ করে বিশ্ব অর্থনীতিতে দেশটি অবদান রাখছে। আমরাও সেটা অনুসরণ করতে পারি।

আবহাওয়া, মাটির গুণাগুণ, তাপমাত্রাসহ ফসল উৎপাদনের প্রয়োজনীয় উপকরণের কথা বিবেচনা করে অঞ্চল ভিত্তিক কোন ফসল চাষ করতে হবে তা যেমন নির্ণয় করা দরকার, আবার ভাল ফসল উৎপাদন করতে দরকার উন্নত জাতের বীজ। টিস্যু কালচার পদ্ধতির মাধ্যমে হাইব্রিড বীজের উৎপাদন ও সরবরাহ করা দরকার। শহর ও গ্রামের সম- ফাঁকা জমি এমনকি অফিস-আদালতসহ প্রতিটি বাড়ির আঙিনাতে চাষাবাদ কার্যক্রম শুরু করতে হবে।

আমাদের কৃষি ও কৃষিজ উপখাতগুলো ক্রমসংকুচিত হয়ে পড়েছে। অধিক জনসংখ্যার জন্য আজ কৃষি জমি বেহাত হচ্ছে, বন ও চাষের জমি উজাড় হচ্ছে, কীট-পতঙ্গ ও জলজ প্রাণীর বসতি ধ্বংস হচ্ছে। আর অবক্ষয়ের কারণে দেশের মাটি ও পানির শক্তি হারিয়ে গিয়ে জীববৈচিত্র নিঃশেষিত হচ্ছে। অর্থাৎ আমরা এখন স্বীকার করতে পারি পরিবর্তিত যে পরিবেশ এই দেশকে ঘিরে এগিয়ে যাচ্ছে, তাতে আমাদের কৃষিক্ষেত্র প্রভাবিত হচ্ছে। জমি যেমন সংকুচিত হয়ে পড়ার কারণে কৃষিজ উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এজন্য পরিবেশকে স্বাভাবিক রাখতে অঞ্চল ভিত্তিক এখনই কি করণীয় তা উপস্থাপন করে, সে আলোকে পদক্ষেপ গ্রহণ করা খুবই জরুরি। পরিবেশ ছাড়াও কৃষির উৎপাদনের সাথে জড়িত প্রত্যেকটি পর্যায়কে নিয়ে সমম্বিত নীতি বা কৌশল অবলম্বন করে দীর্ঘ মেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের দেশ। ২০০৭ সালের প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন শৈত-প্রবাহে ও মঙ্গাপ্রবণ এলাকায় ধানসহ কৃষি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। খরায় দেশের ৫ হাজার মেঃ টন ধান উৎপাদন কম হয়েছে। কালবৈশাখী ঝড়ে ৫ হাজার হেঃ জমির ফসল, ঘরবাড়ি, বৃক্ষ ধ্বংস হয়েছে। বন্যায় ১·৬৪ লাখ একর জমির ফসল শেষ হয়ে গেছে। মৎস্য সম্পদ ও ঘরবাড়ি নষ্ট হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে ঘরবাড়ি, ক্ষেতের ফসল, মৎস্য ও পশু সম্পদের হয়েছে ব্যাপক ক্ষতি। ভৌত অবকাঠামো বিলিন হয়ে গেছে। যে ক্ষতি আগামী ৪০ বছরেও পুষিয়ে নেওয়া যাবে না।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের এতসব কারণের পরেও আমাদের দেশে কৃষিতে যে ফসল উৎপাদন হয়, তা শুধু মাটি, আবহাওয়া, বীজ এবং কৃষকের নিজস্ব ধ্যান-ধরণার গুণে। প্রযুক্তিগত জ্ঞান অ্বেষণ করে এবং তথ্যগত আদান-প্রদানের মাধ্যমে কৃষিকে আরও সম্প্রসারণ করা সহজ হয়।

১৯৯৭ সালে আমাদের দেশে “কৃষি সম্প্রসারণ নীতি” চালু করা হয়েছে। যার লক্ষ হচ্ছে দেশের সকল সেবাদানকারী সংস্থা সকল কৃষককে তার চাহিদা অনুযায়ী সমন্বিত কৃষি সম্প্রসারণে সেবা দিতে হবে। ইতোপূর্বে এ দেশে “একটি বাড়ি একটি খামার” শ্লোগানকে দিয়ে কৃষি আন্দোলন শুরু করা হলেও তার বা-বায়ন তেমন এগোয়নি। দীর্ঘ মেয়াদে দেশে কৃষি উন্নয়নে পরিকল্পনা গ্রহণ না করার ফলে আমাদের এ খাতে কাংখিত অবদান রাখতে পারছে না। আমরা যখন আঞ্চলিক কৃষি উন্নয়নের কথা বলছি, তখন থাইল্যান্ডে “একটি গ্রামে একটি পণ্য” নামে সরকারের সফল কর্মসূচি বা-বায়ন করছে, অর্থাৎ দেশের জনগণ ভিন্ন ভিন্ন স্থান হতে প্রয়োজনীয় সকল ফসল উৎপাদন করে তা ভোগ করতে পারে। তদ্রূপ বাংলাদেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয়, আবহাওয়াসহ অঞ্চল ভিত্তিক সহনশীল পরিবেশ বিবেচনা করে ফসল নির্বাচন করতে হবে। এভাবে প্রয়োজনীয় সকল পণ্য উৎপাদন করতে এলাকা বিভাজন ও চিহ্নিত করা এখন খুবই জরুরি, যাতে করে কোন উৎপাদনের অভাবে আমাদের অন্যের প্রতি নির্ভর করতে না হয়।

- গৌতম কুমার রায়, কুষ্টিয়া

কোন মন্তব্য নেই: