রবিবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০০৯

দেশি মাছ রক্ষার উপায়-৩

দেশি মাছ রক্ষার উপায়-৩



এর আগে দুটি পর্বে দেশি জাতের মাছ রক্ষার কৌশলের কথা উল্লেখ করেছিলাম। আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে এ লেখাগুলো লিখছি। অনুসন্ধিৎসু মন ও ব্যবসায়ীক চিন্তা থেকে আমি এ কাজগুলো করছি। কাজগুলো করতে গিয়ে মনে হয়েছে মনযোগ সহকারে কোন কাজ করলে অবশ্যই সফল হওয়া যায়। এ পর্বে পুকুরে কীভাবে শোল মাছের পোনা উৎপাদন করা যায় তার বিবরণ থাকছে-
শোল মাছের প্রজননের অভিজ্ঞতার কথাঃ ২০০০ সালে অমি বিভিন্ন হাওড়-বাওড় থেকে বিভিন্ন আকৃতির প্রায় হাজার খানেক শোল মাছ সংগ্রহ করি প্রজননের জন্য। এর আগে ১৯৯৮ সালে দেশি মাগুর ও ১৯৯৯ সালে শিং, ২০০০ সালে চিতল ও ফলি মাছের প্রজননে সফলতা পাই। আগামী পর্বগুলোতে এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখার আশা রাখছি। শিং ও মাগুর মাছের প্রজননে সফলতাই আমাকে শোল মাছের প্রজননে উদ্বুদ্ধ করে। আগেই উল্লেখ করেছি, হাওড়-বাওড় থেকে প্রায় হাজার খানেক শোল মাছ সংগ্রহ করি। পুকুরে ব্রুড শোল মাছগুলোকে মজুদ করার পর ব্যাপক ক্ষত দেখা দেয়। তখন ছিল শীতকাল। শীতকালে শোল মাছে এমনিতেই ব্যাপক ক্ষত রোগ দেখা দেয়। বিভিন্ন চিকিৎসা শেষে মাছ সুস্থ হল কিন্তু হাজার খানেক থেকে ৮০ টির মত কংকাল সার মাছ পাওয়া গেল। কোন খাবার খায় না। খাবার নষ্ট হতে হতে পুকুরের পানি নষ্ট হয়ে গেল। অজানা পথে অনেক টাকার অপচয় করলাম। এ দিকে শোলমাছগুলোকে আমার পাকা পুকুরে স্থানান্তর করলাম। শোল মাছগুলোকে পাকা পুকুরে স্থানান্তর করার পর আরও কয়েকটি মাছ মারা গেল। কোন অবস্থাতেই খাবার খাওয়াতে পারছিলাম না। অনেক টাকা বিনিয়োগ করার পরও যখন কোন অবস্থাতেই শোল মাছগুলোকে খাওয়াতে পারছিলাম না। একদিন সন্ধ্যাবেলায় ওই পুকুরের পাড়ে বসেছিলাম। হঠাৎ করে একটি ছোট ব্যাঙ লাফ দিয়ে পুকুরে পড়ে গেল।
আর পড়ে যাওয়া মাত্রই কয়েকটি শোল মাছগুলো দৌড়ে এল। মুহূর্তের মধ্যেই ব্যাঙটিকে নিয়ে গেল। সেই মুহূর্তে আমিও পেয়ে গেলাম শোল মাছের খাবার। যারা খালেবিলে মাছ ধরে তাদের ছোট ব্যাঙ ধরে আনতে বললাম। প্রথম দিন প্রায় ৫ কেজি ব্যাঙ ধরে পাকা পুকুরে ছাড়া মাত্রই সমস্ত পুকুর জুড়েই এক ঝলকে তাণ্ডব হয়ে গেল। ৫ মিনিটের মধ্যেই সমস্ত ব্যাঙগুলোকে উদরে পুড়ে ফেলল ক্ষুধার্থ শোল মাছগুলো। প্রথম দিকে আমি এ দৃশ্য দেখে খুবই তৃপ্তি পাচ্ছিলাম। কিন্তু পর মুহূর্তে আমার মধ্যে একটা অনুশোচনা কাজ করল এই জন্য যে, এতগুলো ব্যাঙকে এ ভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া উচিৎ হয়নি। সপ্তাহখানেক শোল মাছকে খাবার না দিয়ে পরবর্তীতে আবার ব্যাঙ দিতে শুরু করি এই ভেবে যে, সবই একটি ধারাবাহিক পদ্ধতির মধ্যে চলে। বিলে এই মাছ থাকলে কোন না কোনভাবে ব্যাঙ বা অন্যকোন জলজ প্রাণী খেয়ে বেঁচে থাকতো। এভাবে নিয়মিত ব্যাঙ খাওয়ানোর পর মাছগুলো হয়ে উঠল বেশ মোটাতাজা। এরপরে এল বৈশাখ মাস। মাছগুলোর পেটে ডিম এল।
প্রজনের জন্য একজোড়া পুরুষ ও একজোড়া স্ত্রী শোল মাছ নির্বাচন করলাম। ২টি মাত্রায় পি·জি· হরমোন দিয়ে ইঞ্জেকশান করলাম। ২টি মাত্রাতেই ডিম দিল ঠিকই কিন্তু পুরুষ মাছের র্স্পাম পাওয়া গেল না। তাড়াতাড়ি পুরুষ মাছের পেট কেটে টেস্টিজ বের করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু অন্যান্য মাছের মত শোল মাছের টেস্টিজের আকার স্পষ্ট না থাকায় বুঝা যাচ্ছিল না কিছুই। অনেকটা ফুলের মত টেস্টিজে র্স্পাম থেকে কেটে তাড়াতাড়ি ডিমের সাথে পাখির পালকের সাহায্যে মিশিয়ে বোতল জারে দেয়া হল। কিন্তু ডিমগুলো বোতল জারে ভেসে উঠল। ডিমগুলো পানিতে ভেসে থাকাতে দেখে খুবই আশ্চর্য হলাম। এর আগে কখনও মাছের ডিম পানিতে ভেসে থাকতে দেখিনি।


এ যেন এক নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম আমি। শোল মাছের ডিম পানিতে ভেসে থাকতে দেখে মনে হল এভাবে ডিম ভেসে থাকলে ডিম হয়তোবা ফুটবে না। সে ধারণা থেকে ডিমগুলো জার থেকে সরিয়ে সিস্টার্ণে নামিয়ে রাখলাম। পরে ডিমগুলোকে একটি লোহার দণ্ডের ফ্রেম বানিয়ে ফ্রেমের নীচে আটকিয়ে পানিতে ডুবিয়ে রাখা হল। এভাবে প্রায় ২ দিন পর দেখা গেল ফ্রেমের নীচে ডুবন্ত ডিমগুলো নষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে যে ডিমগুলো পানিতে ভাসমান ছিল সে ডিমগুলো থেকে কয়েকটি বাচ্চা পাওয়া গেল। এ দিকে একই সময়ে যে পুকুর থেকে মাছগুলোকে ধরে এনে পাকা পুকুরে রেখেছিলাম সে পুকুরে কয়েকটি মাছ ছিল এবং সেখানে প্রাকৃতিকভাবে ২টি বাইশ (শোল মাছের ঝাঁক) দেখলাম। তখনই পাকা পুকুরের সমস্ত মাছগুলোকে পূর্বের পুকুরে স্থানান্তর করলাম। মাছগুলো স্থানান্তরের ১৫ দিন পর প্রচুর পরিমানে শোল মাছের বাইশ (শোল মাছের পোনার ঝাঁক) দিতে লাগল। আর তখন এই বাইশগুলোকে ঠেলে জাল দিয়ে ধরে একের পর সিস্টার্ণে ভরতে লাগলাম। প্রথমে কোন খাবার খাচ্ছিল না। পরে চিংড়ির শুটকি ভালভাবে পাউডার করে দেয়ার পর ধীরে ধীরে খেতে শুরু করল। সপ্তাহখানেকের মধ্যে শোল মাছের বাচ্চাগুলো চিংড়ির শুটকি খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেল। এভাবে ১ মাসে প্রায় ২/৩ লক্ষ শোল মাছের পোনা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু শোল মাছের চাষ পদ্ধতি জানা না থাকার কারণে বাজারজাত করা যায়নি। শেষ পর্যন্ত পাশের বিলে অবমুক্ত করা হল। অনেক টাকা বিনিয়োগের লোকসান ঘটিয়ে শোল মাছের পোনা উৎপাদনের পরিসমাপ্তি ঘটল। (চলবে)

- এ· কে· এম· নূরুল হক

“গাছ ও মাছে বাংলাদেশ” কিছু প্রস্তাবনা

“গাছ ও মাছে বাংলাদেশ” কিছু প্রস্তাবনা





বাংলাদেশের প্রধান সড়কগুলোর নির্মাণ বা উন্নয়নের জন্য রাস্তার দুপাশের মাটি কেটে খাল তৈরি করা হচ্ছে। এ খালের জন্য সামান্য জায়গা ছাড়া রাস্তার দুপাশের জমি কেবলমাত্র কৃষিজমি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সামগ্রিক উন্নয়নের জন্য এই খাল ভরাট করা প্রয়োজন। খালের কারণে সড়ক ও মহাসড়কের আশপাশের জমি উন্নয়নের ছোঁয়া পাচ্ছে না। প্রাথমিক সমীক্ষামত সড়ক ও মহাসড়কের দুদিকের নীচু জমি বা ধানক্ষেত হতে ১ কিলোমিটার জমির মধ্যে ৩০০ মিটার নীচু জমি উঁচু জমিতে রূপান্তর করা প্রয়োজন। তা করার জন্য মাটি ভরাট করা হলে দেশজুড়ে কয়েক’শ কোটি একর উঁচু জমি পাওয়া যাবে। এই নীচু জমি উঁচু জমিতে রূপান্তর করতে গেলে আরও বেশ কয়েক’শ কোটি একর মাছ চাষের উপযোগী জলাভূমিতে রূপান্তরিত হবে। এই জলাশয়ের পানি দিয়ে প্রয়োজনে জমিতে সেচের ব্যবস্থা করা যাবে। বর্তমানে বাংলাদেশে বর্ষাকালে যে পানির প্রবাহ থাকে তা বিশেষ কয়েকটি বাঁধ ছাড়া অন্যকোন এলাকায় জমিয়ে রাখার মত কোন ব্যবস্থা নেই। বর্ষার পানিকে এসব খালে ধরে রাখা যেতে পারে।
বাংলাদেশের জেলা-উপজেলা ও আন্তঃনগর সংযোগের প্রধান সড়কগুলোর দুপাশের এক কিলোমিটার করে মোট দুকিলোমিটার নীচু জমি “গাছ ও মাছে বাংলাদেশ” নামক একটি প্রকল্পের আওতায় আনতে হবে। রাস্তার দুপাশে নীচু জমি যেখানে কেবল ধানচাষ হয় তার দুপাশ হতে ১ কিলোমিটার জমির মধ্যে প্রথম ৩০০ মিটার জমি বর্তমান রাস্তার উচ্চতা হতে ১ মিটার উঁচু করে মাটি ভরাট করতে হবে। এই ৩০০ মিটার নীচু জমি বা ধানক্ষেত ভরাট করতে পরবর্তী ৬০০ মিটার নীচু জমি বা ধানক্ষেত ২ মিটার গভীর করে কাটা হলে বর্তমান অবস্থান হতে ওই ৩০০ মিটার নীচু জমি ৪ মিটার উঁচু জমিতে রূপান্তরিত হবে। উঁচু জমির যে পাশ থেকে বছরের অধিকাংশ সময়ে সূর্যরশ্মি আসবে সে পাশে রবিশস্য এবং বাকি জমিতে কাঠের জন্য গাছ লাগাতে হবে।
যে এলাকা ৪ মিটার মাটি ভরাটের পরও পাশের রাস্তা হতে ১ মিটার উঁচু হবে না সে জমি প্রয়োজনে ২·৫ মিটার বা ৩ মিটার করে কাটা হবে তাহলে ৪ মিটারের পরিবর্তে উক্ত নীচু জমি ৫ বা ৬ মিটার উঁচু করা যাবে। ৩০০ মিটার উঁচু জমি পাওয়া যাবে এবং ৬০০ মিটার নীচু জমি বা জলাশয় পাওয়া যাবে। রাস্তার উভয় পাশে ১ মিটার উঁচু ৩০০ মিটার চওড়া বিশাল এলাকা পাওয়া যাবে। যা সড়ক বা মহাসড়কের পাশে বাধাহীনভাবে দীর্ঘ হবে। সেখানে রাস্তার পাশে গ্রাম বা উঁচু জমি পাওয়া যাবে সেখানে প্রকল্পটির সীমানা শেষ হবে। এছাড়া এলাকা ভিত্তিক ১ বর্গ কিলোমিটার করে আলাদা আলাদা প্রকল্প করা যাবে।
১০০০ মিটার চওড়া ১০০০ মিটার দীর্ঘ একটি প্রকল্পে প্রায় ২৪৬ একর জমি থাকবে যা থেকে ৭৪ একর উঁচু জমিতে রূপান্তরিত হবে এবং ১৫০ একর জলাশয় এ রূপান্তরিত হবে। প্রতি কিলোমিটার রাস্তার দুপাশে ১৫০ একর উঁচু জমি এবং ৩০০ একর পানি ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন মাছ চাষ উপযোগী জলাশয় পাওয়া যাবে।

এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে-
১· এলাকাভিত্তিক জমির মালিকরা সমবায় সমিতির সদস্য হয়ে তাদের জমির হারাহারি মালিকানার বিপরীতে সমিতির শেয়ার লাভের মাধ্যমে সমবায় সমিতির নামে জমির একক মালিকানা প্রদান করবেন। অথবা সকলে একসাথে তাদের জমি হারাহারি মালিকানার বিপরীতে উপযুক্ত ডেভলপার নিযুক্ত করে দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তির মাধ্যমে “গাছ ও মাছে বাংলাদেশ” প্রকল্পের বাস্তবায়ন করবেন।
২· সরকার জমি রিকুইজিশন করে মালিকদেরকে ক্ষতিপূরণের টাকা প্রদান না করে জমির মালিকগণকে উন্নয়ন এর জন্য “গাছ ও মাছে বাংলাদেশ” নামক প্রকল্পের অংশীদার হিসেবে তাদের কাছে লীজ প্রদান করবেন। সংযুক্ত নকশা অনুযায়ী রাস্তার দুপাশে ২ কিলোমিটার উঁচু জমি ও খাল কাটার পানি কীভাবে থাকবে তা প্রদর্শিত হয়েছে। এই ১ বর্গ কিলোমিটার জমির মালিকরা নিজেদের তহবিল হতে অথবা ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে এই প্রকল্প চালাতে পারে অথবা আগ্রহী ব্যবসায়ীদের যৌথ উন্নয়নের অংশীদার করার মাধ্যমে এই প্রকল্পের কাজ শুরু করতে পরেন। রাস্তার পাশের উঁচু জমির এক অংশে গাছ লাগাতে হবে আর অপর অংশে পেঁয়াজ, রসুন ও অন্যান্য রবিশস্য উৎপাদন করা হবে। বিভিন্ন এলাকায় মাটি পরীক্ষা করে সঠিক ফসল উৎপাদন করার ব্যবস্থা করা হবে। বাকি ৬০০ মিটার পানিতে মাছ চাষ করা যাবে। এই কয়েক কোটি একর উঁচু জমি ও মাছ চাষের জন্য জলাশয় পূর্বের ধানক্ষেত্রে উৎপাদন অপেক্ষা অনেক বেশি টাকা আয় করবে। এই ৬০০ মিটার পানির পর আরও ২০ মিটার উঁচু দুটি পাড় ও ৫০ মিটার পানির আরও একটি জলাশয় থাকবে। এই উঁচু জমি ও গাছ লাগানোর কাজে লাগবে আর পানি সেচ কাজের জন্য ব্যবহৃত হবে। এই রিকুইজিশনকৃত জমির লীজ দেবে একটি সমবায় সমিতির নামে যেখানে রিকুইজিশনকৃত জমির মালিকরা তাদের জমির হারাহারি অংশ অনুযায়ী সমবায় সমিতির শেয়ারের মালিক হবেন। এই সমবায় সমিতি ব্যাংক ঋণের মাধ্যমে নিজেরাই এই ৫/৬ কোটি টাকা মূলধন হিসেবে বিনিযোগ করে “গাছ ও মাছে বাংলাদেশ” প্রকল্পের বাস্তôবায়ন হবে। যদি সমবায় সমিতি নিজেরা ৫/৬ কোটি টাকার ব্যবস্থা না করতে পারে তাহলে রিয়েল এস্টেট ডেভেলাপারদেরে সাথে যৌথ উদ্যোগে এই প্রকল্প বাস্তôবায়ন এর ব্যবস্থা করতে হবে।
অনেকক্ষেত্রেই অশিক্ষিত জমির মালিকদের নিজস্ব উদ্যোগে এই সমবায় সমিতি করবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই তাই এ উদ্যোগ বর্তমান সরকারকেই নিতে হবে। জমি অধিগ্রহণ করার পর জমির মালিকদের বাধ্য করতে হবে সমবায় সমিতির সদস্য হওয়ার জন্য। জমির মালিকরা সমিতির মাধ্যমে মালিক থাকবেন বিষয়টি সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে পারলে অধিগ্রহণ বা যৌথ উন্নয়ন কোন বিষয়েই জমির মালিকরা বাধা সৃষ্টি করবেন না। অন্যথায় সরকারি আইন মোতাবেক রিকুইজিশন করে জমির ব্যবহার বিধি অনুযায়ী রাস্তার পাশের নীচু ধানক্ষেত কেবল মাত্র “গাছ ও মাছে বাংলাদেশ” প্রকল্প হিসেবে গড়ে তোলা বাধ্যতামূলক করতে হবে।
এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে মডেল হিসেবে প্রথমে যদি আমরা যে কোন জায়গায় রাস্তার পাশে ১০০০ মিটার X ১০০০ মিটার জমির ব্যবস্থা করতে পারি তাহলে নিম্ন বর্ণিত উপায়ে তা বাস্তবায়ন করা যাবে। প্রতি বর্গ কিলোমিটার জমিতে ১০০০ মিটিার X ১০০০মিটার =১০,০০,০০০ বর্গমিটার জমি পাওয়া যাবে। ১০০০ X ১০০০ = ১০,০০,০০০ বর্গমিটার।
প্রতি বর্গ কিলোমিটার জমিতে ৭০ একর উঁচু জমি এবং ১৪০ একর জলাশয় পাওয়া যাবে। প্রতি বর্গ কিলোমিটার জমিতে যৌথ উদ্যোগে জমির মালিকদের সাথে ডেভেলপারদের যৌথ উন্নয়নে ও যেতে পারেন। জমির মালিকরা নিজেরাই কো- অপারেটিভের মাধ্যমে জমির যৌথ মালিকানা সৃষ্টি করতে পারেন। উক্ত জমির মালিকের কো-অপারেটিভ যে কোন উপযুক্ত রিয়েল এটেষ্ট ডেভেলপারের সাথে চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে গাছ ও মাছ চাষের ব্যবস্থা করতে পারবেন।
একটি হিসেবে দেখা গেছে প্রতি বর্গ কিলোমিটার জমিতে মাটি কেটে ৩০০ X ১০০ মিটার মাটি ভরাট করতে প্রায় ৫ কোটি টাকার মত বিনিয়োগ করতে হবে। ৫ কোটি টাকা বিনিয়োগের পর এলাকা ভিত্তিক উঁচু জমির ধরন বুঝে বিশেষজ্ঞ দ্বারা মাটি পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ও উপযুক্ত রবিশস্যসহ সকল প্রকার বৃক্ষ ও দীর্ঘ মেয়াদে গাছ রোপণ করার ব্যবস্থা করতে হবে। অপর দিকে ৬০০ X ১০০০ মিটার এর প্রকল্প ১৫/২০ বা এর অধিক সময় পর্যন্ত যৌথ উন্নয়নে উন্নত করে অধিক বৃক্ষ রোপণ, অনেক বেশি রবিশস্য প্রায় সকল প্রকার ফলের চাষ আমাদের বাংলাদেশে সম্ভব হবে।
শরীফ হোসেন চৌধুরী

শীতের সবজি ব্রোকলি


শীতের সবজি ব্রোকলি





ব্রোকলি বা সবুজ ফুলকপি এদেশে একটি নতুন কপিজাতীয় সবজি। শীতকালীন সবজির মধ্যে ব্রোকলি বর্তমানে আমাদের দেশে চাষ করা হচ্ছে। এর বৈজ্ঞানিক নাম Brassica oleracea var. italica.ব্রোকলি অন্যসব কপি জাতীয় সবজির চেয়ে উন্নত পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে, প্রতি ১০০ গ্রাম খাবার উপযোগী ব্রোকলিতে ৫·৫ গ্রাম শ্বেতসার, ৩·৩ গ্রাম প্রোটিন, ২১০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি, ৩৫০০ আইইউ ভিটামিন এ রয়েছে। এছাড়াও ব্রোকলিতে প্রচুর পরিমাণ আয়রন ও ক্যালসিয়াম বিদ্যমান। ব্রোকলি অত্যন্ত উপাদেয়, সুস্বাদু ও পুষ্টিকর একটি সবজি।
এটি চোখের রোগ, রাতকানা, অস্থি বিকৃতি প্রভৃতির উপসর্গ দূর করে ও বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। জমি তৈরিঃ ব্রোকলি চাষের জন্য জৈব সার সমৃদ্ধ, সুনিষ্কাশিত, উর্বর দো-আঁশ বা বেলে দো-আঁশ মাটিযুক্ত জমি নির্বাচন করা উত্তম। জমিতে মাটির পিএইচ মান ৬ থেকে ৭, দিনে গড় তাপমাত্রা ২০ থেকে ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ব্রোকলি চাষের জন্য উত্তম। জমিতে কয়েকবার আড়াআড়ি ও গভীর চাষ দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে করে নিতে হবে। এরপর আগাছা পরিস্কার ও জমি সমান করে বেড তৈরি করতে হবে। জাত নির্বাচনঃ ব্রোকলি আমাদের দেশে নতুন সবজি। কাজেই এখন পর্য- তেমন কোন ভাল জাত আমাদের দেশে নেই। উন্নত বিশ্বের বেশ কয়েকটি জাত যেমন- প্রিমিয়াম ক্রস, গ্রীন কমেট, জুপিটার প্রভৃতি জাতের ব্রোকলি চাষ করা যায়। লালতীর সীডস লিমিটেড ‘লিডিয়া’ নামে ব্রোকলির একটি জাত বাজারজাত করছে, যা আমাদের দেশের আবহাওয়া উপযোগী। জাতটি দ্রুত বর্ধনশীল, মাঝারি আকৃতির, তাপ সহিষ্ণু ও রোগ প্রতিরোধী, দেখতে আকর্ষণীয় ও খেতে সুস্বাদু।বীজ বপনঃ আমাদের দেশের আবহাওয়ায় ব্রোকলি চাষের উত্তম সময় হল আশ্বিন থেকে পৌষ মাস। চারা রোপণের আগে বিঘাপ্রতি (৩৩ শতক) প্রায় ৫০ গ্রাম বীজ বপন করে বীজতলায় চারা তৈরি করতে হবে। এরপর মূল জমিতে চাষের জন্য বিঘাপ্রতি ৬ হাজার চারা রোপণ করতে হবে। প্রায় ৪ থেকে ৫ সপ্তাহ বয়সের চারা সারি থেকে সারি ৫৫ সে·মি· ও চারা থেকে চারা ৪৫ সে·মি· দূরত্বে রোপণ করলে ভাল ফল পাওয়া যায়।

পাশাপাশি দুটি বেডের মাঝে ৩০ সে·মি· চওড়া এবং ১৫ সে·মি· গভীর নালা রাখতে হবে।সার প্রয়োগঃ ব্রোকলির উত্তম ফলন পেতে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান অবশ্যই দরকার। এজন্য জমি তৈরির সময় ও পরবর্তীতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ জৈবসার ও রাসায়নিক সার প্রয়োগ করতে হবে। ব্রোকলি চাষের মূল জমি তৈরির সময় বিঘাপ্রতি ২ টন পচা গোবর বা কম্পোস্ট সার, ২৫ কেজি খৈল, ২৫ কেজি ইউরিয়া, ১৫ কেজি টিএসপি, ২০ কেজি এমওপি সার প্রয়োগ করতে হবে। এছাড়াও পরিমাণমত জিপসাম, জিংক ও বোরন সার এবং বিঘাপ্রতি ২ কেজি হারে রুটোন বা অন্য কোন শিকড় বর্ধনকারী হরমোন প্রয়োগ করতে হবে। জমি তৈরির সময় জিংক ও বোরন না প্রয়োগ করে চারা লাগানোর ২০ থেকে ২৫ দিন পর প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১০ গ্রাম লিবরেল জিংক ও ২০ গ্রাম লিবরেল বোরন একত্রে মিশিয়ে স্প্রে করা যায়। তবে রাসায়নিক সারের পরিবর্তে জৈব সার ব্যবহার করা উত্তম। অন্যান্য পরিচর্যাঃ ব্রোকলির চারা লাগানোর পর বেশকিছু বাড়তি পরিচর্যা করতে হবে। জমিতে আগাছা হলে সাথে সাথে নিড়ানি দিতে হবে। মাঝে মাঝে নিড়ানি দিয়ে মাটি আলগা করে দিতে হবে। এছাড়া সূর্যালোকে উম্মোচিত থাকলে ফুল হলুদাভ বর্ণ ধারন করতে পারে। তাই চারদিকের পাতা দিয়ে ফুল ঢেকে দিতে হয়, যা ব্লাচনিং নামে পরিচিত। অনেক সময় আগাম জাতের ব্রোকলি দেরিতে রোপণ করলে বা জমিতে নাইট্রোজেন পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি হলে ফুল ছোট হয়ে যেতে পারে। এসময় ইনডোল বিউটারিক এসিড জাতীয় জৈব হরমোন স্প্রে করলে বা ইউরিয়া উপরি প্রয়োগের পর সেচ দিলে উপকার পাওয়া যায়।ফসল সংগ্রহ ও ফলনঃ চারা রোপণের দুই মাসের মধ্যে ব্রোকলির অগ্রীয় প্রোপুষ্প মঞ্জুরী খাওয়ার জন্য সংগ্রহ করা যায়। তবে সঠিকমানের জৈব হরমোন ব্যবহার করলে প্রায় ১০ দিন আগে ফসল সংগ্রহ করা যায়। প্রায় তিন ইঞ্চি কাণ্ডসহ ধারালো ছুরি দিয়ে ফুল কেটে সংগ্রহ করতে হয়। এর ১০ থেকে ১২ দিন পর পর্যায়ক্রমে বোঁটাসহ কক্ষীয় প্রোপুষ্পমঞ্জুরী সংগ্রহ করতে হয়। সঠিক পরিচর্যা করলে বিঘাপ্রতি ২থেকে ২·৫ টন ফলন পাওয়া যায়।

কৃষিবিদ মোঃ কামরুল আহসান ভূঁইয়া

ইউরিয়া স্প্রেঃ আব্দুল আজিজ ফর্মূলা

ইউরিয়া স্প্রেঃ আব্দুল আজিজ ফর্মূলা

দেশ বাঁচতে পারে ৮ হাজার কোটি টাকার আমদানি ব্যয় থেকে?






মাটি ও মানুষের কৃষি ডেস্ক
ইউরিয়া ব্যবহারের আরেক ফর্মূলা রীতিমত সাড়া ফেলেছে। ক’দিন চ্যানেল আই সংবাদে প্রচারিত হচ্ছে বিষয়টি। ঘাটাইলের আব্দুল আজিজ নামের একজন কৃষক ইউরিয়া প্রয়োগের প্রচলিত সব পদ্ধতি বাদ দিয়ে পানিতে গুলিয়ে স্প্রে করছেন। আর এর মধ্য দিয়ে ইউরিয়ার ব্যবহার কমানো যাচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ। কোথাও তার চেয়েও বেশি। এ পদ্ধতির চাক্ষুস সফলতা পেয়েছেন তিনি। জানা গেছে, প্রায় ১৬ বছর ধরে বিভিন্ন ফলফলাদির গাছে পানিতে ইউরিয়া মিশিয়ে প্রয়োগ করে আসছেন কৃষক আজিজ। এতে আনারসে ৫৬ শতাংশের এক পাখি (স্থানীয় হিসাব) জমিতে ৬ হাজার কেজি ইউরিয়ার চাহিদা মিটে যাচ্ছে মাত্র ৬০ কেজিতে, আবার উচ্চফলনশীল কুল যেমন বাউকুল, আপেল কুল কিংবা থাই কুলের ক্ষেত্রে এক একর জমিতে যেখানে প্রায় দু হাজার কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করে কৃষকরা সেখানে এ পদ্ধতিতে মাত্র ২০ কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করলেই পাওয়া যাচ্ছে কাঙ্ক্ষিত ফলন।
বিস্ময়কর এ তথ্য পাওয়ার পর মাটি ও মানুষের কৃষি’র পক্ষ থেকে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে বিষয়টির বাস্তôবতা। ঘাটাইলের শালিয়াবহ গ্রামের আব্দুল আজিজের হাত ধরে এ পদ্ধতি পৌঁছেছে অনেক দূর। এবার বোরো মৌসুমকে সামনে রেখে আব্দুল আজিজের ফর্মূলায় ইউরিয়া প্রয়োগ করছেন অনেকেই। তার কাছ থেকে অন্য কৃষকরা ইউরিয়া স্প্রে’র চুলচেরা হিসাব জেনে যাচ্ছেন। ১৬ লিটার পানিতে মাত্র ২০০ গ্রাম ইউরিয়া মিশিয়ে যে দ্রবণ তৈরি করা হচ্ছে তা স্প্রে মেশিনের মাধ্যমে ২০ শতাংশ জমিতে প্রয়োগ করা যাবে। এই প্রক্রিয়ায় দুই থেকে তিনবার প্রয়োগ করলেই মিটে যাবে এক মৌসুমে ধানে ইউরিয়ার প্রয়োজনীয়তা। সেখানে ২০ শতাংশ জমিতে তিন দফা ইউরিয়া প্রয়োগের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রথম দফায় ১৬ লিটার পানিতে ২’শ গ্রাম, দ্বিতীয় দফায় ২৫০ গ্রাম এবং তৃতীয় দফায় ৩০০ গ্রাম সর্বমোট ৭৫০ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগের। এই হিসেবে ৩৩ শতাংশের এক বিঘা জমিতে ইউরিয়ার প্রয়োজন হচ্ছে মাত্র ১ কেজির কিছু বেশি। প্রচলিত পদ্ধতিতে কৃষক যেখানে ১ বিঘা বোরো ধানের জমিতে ৪৫ থেকে ৫০ কেজি পর্যন্তô ইউরিয়া ছিটিয়ে আসছে সেখানে এই পরিমাণ শুধু নগণ্যই নয়, বিস্ময়কর বটে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড· আব্দুল মজিদ বলছেন, বিষয়টি বিজ্ঞান বহির্ভূত নয় বরং এ পদ্ধতিতে প্রয়োগ করে ইউরিয়ার চাহিদা অনেক কমানো সম্ভব। তিনি সহযোগী বিজ্ঞানীদের নিয়ে ব্রি’র গবেষণা প্লটে প্রাথমিক পরীক্ষা নীরিক্ষার পর জানান, আব্দুল আজিজের পদ্ধতিতে ইউরিয়া প্রয়োগের মাত্রা ১ দশমিক ২। চারটি প্লটে ওই মাত্রার কাছাকাছি চার মাত্রায় ইউরিয়া স্প্রের পর তিনি জানান, আব্দুল আজিজের ইউরিয়া প্রয়োগ পদ্ধতি যথার্থই বিজ্ঞানস্মত এবং কার্যকর। কারণ, এই প্রক্রিয়ায় ধান গাছ পাতার অসংখ্য ছিদ্রের মাধ্যমে সরাসরি ইউরিয়া গ্রহণ করতে পারে। এতে খুব দ্রুতই গাছ পুষ্ট হয়ে ওঠে। যা ফলনের জন্যও ইতিবাচক। বিজ্ঞানীদের এই মন্তব্যের সঙ্গেও মাটির বিজ্ঞানী আব্দুল আজিজের মন্তôব্য মিলে যায়। আজিজ তার ভাষায় বলেছিলেন, গাছের তো মুখ কিংবা দাঁত নেই, তাই সে পাতার অসংখ্য ছিদ্রের মাধ্যমেই নাইট্রোজেন গ্রহণ করে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন-এ কর্মরত কৃষি প্রকৌশলী ইফতেখারুল ইসলামও আব্দুল আজিজের ইউরিয়া স্প্রে পদ্ধতির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন, ছিটিয়ে ইউরিয়া প্রয়োগ করলে ধান ফসলের জন্য তা ২০ ভাগেরও কম কাজ করে, গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করলে এর চেয়ে কিছুটা উপকার পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে, মাত্রা অনুযায়ী ইউরিয়া স্প্রে করলে তার ফলাফল পাওয়া যাবে প্রায় শতভাগ। যেহেতু ধানের শেকড়ের অংশ উপরিভাগেই বেশি সেহেতু স্প্রে করা হলে সেটিই কার্যকরভাবে গ্রহণ করতে পারে। এদিকে এই প্রক্রিয়ায় মাটিতে নাইট্রোজেন ঘাটতি দেখা দিতে পারে কি-না জানতে চাইলে প্রকৌশলী ইফতেখারুল ইসলাম জানান, ইউরিয়া স্প্রে করা হলে তা শুধু ধান গাছেরর পাতাই গ্রহণ করে না, মাটিও তার প্রয়োজন অনুযায়ী গ্রহণ করে। এর মধ্য দিয়ে মাটিতে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়ার প্রয়োগ কমানো সম্ভব, যার মাধ্যমে মাটি ফিরে পেতে পারে তার হারানো উর্বরা শক্তি। তবে এ ক্ষেত্রে ইউরিয়া স্প্রের বেলায় মাত্রা নির্ধারণের বিষয়টি নিয়ে আরও কার্যকর গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে- বর্তমান সময়ে দেশে বছরে ইউরিয়ার মোট চাহিদা সাড়ে ২৮ লাখ মেট্রিকটন। এর মধ্যে সাড়ে ১৪ লাখ মেট্রিক টন আমদানি করা হচ্ছে আন্তôর্জাতিক বাজার দর হিসেবে যার মূল্য দাঁড়ায় ৮ হাজার কোটি টাকার উপরে। আমদানি ও অভ্যন্তôরীণ উৎপাদন মিলিয়ে বছরে ইউরিয়া প্রয়োগ করা হচ্ছে ১২ থেকে ১৬ হাজার কোটি টাকার। যদিও সরকারি ভর্তূকির কল্যাণে সরকারের ৩০ থেকে ৬০ টাকায় কেনা ইউরিয়া কৃষক এখনও কিনতে পারছে কেজি প্রতি ১২ টাকায়, তারপরও দেশের প্রচুর অর্থ ব্যয় হচ্ছে কৃষির এই উপকরণ বাবদ। আব্দুল আজিজের পদ্ধটি যদি বিজ্ঞানসম্মতভাবে পুরোপুরি কার্যকর হয় তাহলে দেশ কৃষি আবাদে ইউরিয়ার ব্যবহার আশি ভাগ কমিয়ে আনতে পারবে বলে ওয়াকিবহাল মহলের অভিমত। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, পদ্ধতির যদি অর্ধাংশও সঠিকভাবে কার্যকর করা যায় তাহলেও ইউরিয়া আমদানির হাত থেকে রেহাই পাবে বাংলাদেশ। বাঁচবে কমপক্ষে ৮ হাজার কোটি টাকা। তবে এ বিষয়টি নিয়ে কার্যকর গবেষণাই এখন সময়ের দাবি।

শনিবার, ২৪ জানুয়ারী, ২০০৯

মুরগির শীতকালীন ব্যবস্থাপনা


মুরগির শীতকালীন ব্যবস্থাপনা








শীতকালে বাংলাদেশে তাপমাত্রা সর্বনিু ৪-৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যায়। এ সময় খামারি ভাইদের নানা সমস্যায় পড়তে হয়। এ কারণে শীতকালে মুরগি পালনে বিশেষ পরিচর্যার দরকার হয়। তাই লাভজনক খামার ব্যবস্থাপনার জন্য খামারি ভাইদের নিচের বিষয়গুলোর ওপর বিশেষ নজর দিতে হবে।
বাসস্থানঃ শীতকালে বয়সভেদে মুরগির ঘরের ভেতরের পরিবেশ ঠিক করতে হবে। যে বয়সের মুরগি পালন করা হবে সে বয়সের মুরগির জন্য ঘরে উপযোগী পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ঘরের আশপাশের ঝোপ-জঙ্গল কেটে পরিষ্কার করতে হবে, যাতে দিনের আলো পরিপূর্ণভাবে ঘরের চালার ওপর পড়ে। ঘরের দরজা-জানালার ফাঁক ব করে দিতে হবে যেন ঠাণ্ডা বাতাস ঘরে প্রবেশ করতে না পারে। মুরগির ঘরে উপযোগী পরিবেশ তৈরিতে নিচের বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে­
লিটারঃ শীতকালে লিটার হিসেবে ধানের শুকনা তুস সবচেয়ে ভালো। তুষ মুরগিকে গরম রাখে। ব্রুডার হাউসে ৫-১০ সেন্টিমিটার পুরু করে লিটারসামগ্রী বিছাতে হবে। মুরগি যদি ফ্লোরে পালন করা হয়, তাহলে বড় মুরগির জন্য লিটারের পুরুত্ব ৪ ইঞ্চির কম হবে না। লিটারসামগ্রী হতে হবে পরিচ্ছন্ন ও দূষণমুক্ত। কোনো কারণে পানি পড়ে লিটার ভিজে গেলে ভিজা লিটার ফেলে ওই স্থানে শুকনা লিটার বিছাতে হবে। লিটার যেন খুব শুকনা ধুলাময় না হয়।
তাপমাত্রাঃ শীতকালে মুরগি পালনে সবচেয়ে বড় সমস্যা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা। মুরগির ঘরে স্বাভাবিক তাপমাত্রা দরকার ৬৫-৭৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট। তবে ব্রুডার হাউসে প্রাথমিক তাপমাত্রা দরকার পর্যায়ক্রমে ৩৫-২৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যখন পরিবেশের তাপমাত্রা খুব বেশি কমে যায়, তখন ব্রুডারে বাল্ব সংখ্যা বাড়িয়ে দিতে হবে। ঘরের চালা টিনের হলে হার্ডবোর্ড বা এই জাতীয় পদার্থ দিয়ে সিলিং দিতে হবে। ঘর উষ্ণ রাখতে টিনের বা ছাদের ওপর খড় বিছিয়ে দিতে হবে। ঘরে বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা থাকতে হবে। ব্রুডিং পিরিয়ডে বাচ্চা যাতে সমভাবে তাপ পায় এ জন্য ৫০০ বাচ্চার জন্য ১০০ ওয়াটের তিনটি বাল্ব সংযুক্ত একটি ব্রুডার হার্ডবোর্ড বা প্লেনশিট দিয়ে তৈরি চিকগার্ডের মধ্যে স্থাপন করতে হবে।
আলোঃ মুরগির ঘরে আলো এমনভাবে দিতে হবে যেন তা ঘরে সমভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ব্রুডিং পিরিয়ডে প্রথম তিন দিন নিরবচ্ছিন্ন আলো দরকার।
বাচ্চার ঘনত্বঃ ব্রুডার হাউসে প্রতি বর্গমিটারে প্রথমে ৫০টি বাচ্চা রাখতে হবে এবং চার দিন বয়সের পর থেকে ক্রমান্বয়ে জায়গা বাড়িয়ে দিতে হবে। ১৪ দিন বয়সের পর ঘরের তাপমাত্রা ঠিক রেখে বাচ্চা যাতে পুরো ঘরে বিচরণ করতে পারে সে অনুযায়ী জায়গা বাড়াতে হবে। ডিমপাড়া মুরগির শরীরের তাপমাত্রা ঘরের তাপকে কিছুটা প্রশমিত করলেও উৎপাদনের জন্য এটা ভালো নয়। তাই ঘরে মুরগির ঘনত্ব কেমন হবে তা নির্ভর করবে ঘরের ধরন, ব্যবহৃত সরঞ্জামাদি, মুরগির বয়স, জাত ও পালন পদ্ধতির ওপর, পরিবেশের তাপমাত্রার ওপর নয়।
ভেন্টিলেশনঃ মুরগির ঘরে ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা বাতাস প্রবাহের মাধ্যমে ঘরে উৎপন্ন বিষাক্ত বাতাস বের করে এবং বিশুদ্ধ বাতাস প্রবেশ করে। শীতকালে ঘরে ঠাণ্ডা বাতাস যাতে প্রবেশ করতে না পারে সে জন্য সব দরজা-জানালা ব রাখলেও ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা অবশ্যই চালু রাখতে হবে।
খাদ্যঃ শীতকালে ঠাণ্ডা আবহাওয়ায় মুরগি খাবার বেশি খায়। অতিরিক্ত খাবার খেয়ে শরীরে তাপ উৎপাদন করে। অর্থাৎ শীতকালে শরীরে বেশি ক্যালরি দরকার হয়। এ জন্য রেশনে শর্করা-চর্বি উৎপাদনের উৎস কিছুটা বাড়িয়ে দিতে হবে। তবে রেশনের সব খাদ্য উপাদানের পরিমাণগুলো ঠিক রেখে কিছু পরিমাণ তেল মিশিয়ে ক্যালরির পরিমাণ বাড়ানো যায়। ব্রুডিং অবস্থায় প্রথম তিন দিন লিটারের ওপর চট বা কাগজ বিছিয়ে তার ওপর খাদ্য ছিটিয়ে দিলে ভালো হয়। বাচ্চা মুরগিকে অল্প অল্প বার বার খাবার দিতে হবে। ফলে খাবার খাওয়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। শীতকালে সব বয়সের মুরগির উৎপাদন ( গোশত, ডিম) কমে যায়। তাই সরবরাহকৃত খাবারে পর্যাপ্ত পুষ্টি উপাদানের থাকা নিশ্চিত করতে হবে।
পানিঃ মুরগি যা খাবার গ্রহণ করে তার দ্বিগুণ পানি পান করে। তবে শীতকালে ঠাণ্ডার কারণে পানি গ্রহণের পরিমাণ কম হয়। তাই পানি গ্রহণের পরিমাণ ঠিক রাখতে প্রচণ্ড শীতের সময় সকালে ঠাণ্ডা পানি না দিয়ে হালকা গরম দিতে হবে। পানি ভরার আগে পাত্র ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে।
ভ্যাক্সিনেশনঃ সঠিক খামার ব্যবস্থাপনার জন্য একটি ভ্যাক্সিনেশন কর্মসূচি প্রণয়ন করতে হবে। ব্রয়লারের জন্য রানীক্ষেত এবং গামবোরো এই দু’টি ভ্যাক্সিনই যথেষ্ট, তবে ব্রিডার খামারের জন্য সম্পূর্ণ ভ্যাক্সিনেশন কর্মসূচি অনুসরণ করতে হবে। শীতকালে পরিবেশের তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণ বিশেষ করে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ও রানীক্ষেত রোগ সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে। ধারণা করা হয় রানীক্ষেত রোগ প্রতিরোধ করার মাধ্যমে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা সংক্রমণ কমানো যায়। এ জন্য সময়মতো রানীক্ষেত রোগের ভ্যাক্সিন নিয়মিত করতে হবে।
জীবাণুনাশক স্প্রেঃ শীতকালে পরিবেশের তাপমাত্রা কমে যাওয়ার কারণে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়, তাই বাণিজ্যিকভাবে গড়ে ওঠা খামারের আশপাশে ১০০ গজের মধ্যে প্রতিদিন জীবাণুনাশক স্প্রে করতে হবে। মুক্ত পরিবেশে ছেড়ে পালন করা মুরগি যাতে খামারের সংস্পর্শে না আসে এটা খেয়াল রাখতে হবে। এবং ওই সব মুরগি নিয়মিত টিকা প্রদানের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ ওই সব মুরগি থেকেই এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা সংক্রমণের আশঙ্কা বেশি থাকে।
মেডিকেশনঃ শীতকালে রানীক্ষেত, মাইকোপ্লাজমা প্রভৃতি রোগের বিস্তার বেশি ঘটে। রোগাক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্তপূর্বক চিকিৎসা দিতে হবে। তা ছাড়া শীতের কারণে রোগ প্রতিরোধ সামর্থø কমে যাওয়া নিরাময় দুরূহ হয়ে পড়ে।



মোঃ মহির উদ্দিন




এখন করণীয়ঃ গাছের ডালপালা ছাঁটাই


এখন করণীয়ঃ গাছের ডালপালা ছাঁটাই



কাঠজাতীয় গাছের ডালপালা ছাঁটাইয়ের উপযোগী সময় এখন। ফলদগাছের ডালপালা ছাঁটাইয়ের উপযোগী সময় ফল ধরার সময় অথবা ফল সংগ্রহের পর। এ সময় গাছের ডালপালা ছাঁটাই করলে বসন্তকালে এবং বর্ষাকালে গাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এ ছাড়া অন্য সময় ছাঁটাই করলে গাছের ক্ষতি হয়।
গুরুত্বঃ কাঠের পরিমাণ ও গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। রোগবালাই দমন করা যায়। গাছের কাণ্ড সোজা হয়। ফল বেশি ধরে, ফল ঝরে পড়ে না। ফল বড় হয়। কৃষি বনায়নে ফসলের উপকার হয়। গাছের সৌন্দর্য বৃদ্ধি পায়। বরইগাছে ফল সংগ্রহের পর সম্পূর্ণ ডালপালা ছেঁটে দিলে পরের বছর প্রচুর বরই ধরে। লিচু ও আম ধারণের ডাল ছেঁটে দিলে গাছের সব ডালে মুকুল ধরে। গাছ ঝড়-তুফানে ভাঙে না।
পদ্ধতিঃ যেসব ডালপালা হেলে রাস্তার ওপর পড়বে এবং যাতায়াতে অসুবিধা হলে সেসব ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। রোগাক্রান্ত ডালপালা ছাঁটতে হবে যাতে রোগের বিস্তার না হয়। দুর্বল, বাঁকা, বৃদ্ধি হয় না এমন ডালপালা কাটতে হবে। অপ্রয়োজনীয় মরা, শুকনো ও পাতাহীন ডালপালা কাটতে হয়। এতে নতুন কুশি গজায়। একই ডালে বেশি ফল ধরলে ছাঁটাই করে পাতলা করে দিলে ফল বড় ও সুন্দর হয়। পাতাজাতীয় ভেষজগাছের পাতা ছাঁটাই করলে পাতার পরিমাণ বাড়ে।

শিকড় উৎপাদনকারী গাছের শিকড় ছেঁটে দিলে শিকড়ের পরিমাণ বাড়ে। ফুল উৎপাদনকারী গাছের ফুল পাতলা করে দিলে ফুলের গুণগত মান বৃদ্ধি পায়। কৃষি বনায়নে জমিতে ফসল থাকা অবস্থায় ডালপালা কাটা যাবে না। পার্শ্বীয় শাখার গোড়া থেকে সামান্য ওপরে এবং বড় শাখার গোড়ার ধারালো করাত বা দা দিয়ে সমান বা মসৃণ করে কাটতে হবে। কর্তিত অংশে আলকাতরা লাগাতে হবে। অন্যথায় কাটা অংশ দিয়ে জীবাণু প্রবেশ করে গাছ রোগাক্রান্ত হতে পারে। সুস্থ-সবল কুঁড়ি বা পর্বসরি ঠিক উপরেই শাখা কাটা উচিত। অঙ্গ ছাঁটাইয়ের যন্ত্রপাতি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। গাছের সৌন্দর্য বৃদ্ধির দিকে খেয়াল রেখে অঙ্গ ছাঁটাই করতে হবে। সৌন্দর্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে বছরের যেকোনো সময় অঙ্গ ছাঁটাই করা হয়। একই বছর একবারের বেশি অঙ্গ ছাঁটাই করা যাবে না। গাছের বয়স ৩ থেকে চার বছর হওয়ার পর প্রতিবছর একবার অঙ্গ ছাঁটাই করা উচিত।
ফরহাদ আহাম্মেদ কৃষিবিদ

রবিবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০০৯

গাভীর খামার ব্যবস্থাপনা


গাভীর খামার ব্যবস্থাপনা





বাংলাদেশে প্রতিবছর দুধের চাহিদা ১২·৫২ মিলিয়ন মেট্রিক টন, উৎপাদন হচ্ছে প্রতিবছর ২·২৮ মিলিয়ন মেট্রিক টন, ঘাটতি প্রতিবছর ১০·২৪ মিলিয়ন মেট্রিক টন। চাহিদার আলোকে আমাদের দেশে ছোট-বড় প্রায় ৪৭,৭১০টি ডেইরি খামার গড়ে উঠেছে। বর্তমানে শংকর জাতের গাভী পালনের মাধ্যমে দুগ্ধ খামার স্থাপন একটি লাভজনক ব্যবসা। ফলে গাভী পালনে উন্নত ব্যবস্থাপনা, সঠিক প্রজনন, সুষম খাদ্য, রোগদমন ও প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কে আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে খামারিদের জানা প্রয়োজন।
ভালজাতের গাভীর বৈশিষ্ট্য-
মাথাঃ হালকা ও ছোট আকার, কপাল প্রশস্তô, উজ্জ্বল চোখ, খাদ্যের প্রতি আগ্রহ।
দৈহিক বৈশিষ্ট্যঃ দেহের সামনে দিক হালকা, পিছনের দিক ভারী ও সুসংগঠিত, দৈহিক আকার আকর্ষণীয়, শরীরের গঠন ঢিলা।
পাজরঃ পাজরের হাড় স্পষ্ট, হাড়ের গঠন সামঞ্জস্যপুর্ণ।
চামড়াঃ চামড়া পাতলা, চামড়ার নীচে অহেতুক চর্বি জমা থাকবে না, চামড়ার রঙ উজ্জ্বল, লোম মসৃণ ও চকচকে হবে।
ওলানঃ ওলান বড় সুগঠিত ও দেহের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, বাটগুলো একই আকারের হবে। চারবাট সমান দূরত্বে ও সমান্তরাল হবে। দুগ্ধশিরাঃ দুগ্ধশিরা মোটা ও স্পষ্ট, তলপেটে নাভীর পাশ দিয়ে দুগ্ধশিরা আঁকাবাঁকাভাবে বিস্তৃত থাকবে।

খামার ব্যবস্থাপনাঃ খামার ব্যবস্থাপনা এক প্রকার কৌশল যার মাধ্যমে খামারের সম্পদ, সুযোগ ও সময়ের সমন্বয় ঘটানো যায়। সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার সুফল হল- ১· সম্পদের মিতব্যয়িতা ২· স্বল্প সময়ে ফললাভ ৩· স্বল্প সময়ে অধিক উৎপাদন ৪· শক্তি ও শ্রমের অপচয় রোধ ৫· উৎপাদনে গুণগতমান ও উৎকর্ষতা লাভ।

সাধারণ ব্যবস্থাপনাঃ গাভী তার গুণগতমান উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে থাকে। কিন্তু গাভীর বংশানুক্রমিক গুণগতমান যতই ভাল হোক এর ব্যবস্থাপনা সমন্ধে বিশেষ যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। দৈনন্দিন পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা, বিজ্ঞান সম্মত বাসস্থান, সুষম খাদ্য সরবরাহ, সঠিক প্রজনন, রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ইত্যাদি উন্নত গাভী পালনের মৌলিক বিষয়।

বাসস্থানঃ পারিবারিক পর্যায়ে বা খামার পর্যায়ে গাভী পালন করতে হলে গাভীর জন্য ভাল বাসস্থান প্রয়োজন। গাভীকে বিভিন্ন প্রতিকূল অবস্থা যেমন- ঝড়, বৃষ্টি, অতিরিক্ত ঠাণ্ডা ও গরম এবং অন্যান্য নৈসর্গিক দৈব দুর্বিপাক, পোকামাকড়, চোর, বন্য-জীবজন্তু হতে রক্ষা করার জন্য যথোপযুক্ত বাসস্থান বা গোয়ালঘর প্রয়োজন। আমাদের আবহাওয়ার আলোকে ঘরে প্রচুর আলো বাতাস চলাচলের জন্য ঘরটি উত্তর-দক্ষিণমুখী হওয়া বাঞ্চনীয়। কোন অবস্থাতেই যেন ঘরে স্যাঁতস্যাঁতে অবস্থা যেন না থাকে। এতে ঘরের মেঝেটি ইট বিছানো থাকলে ভাল হয়। ঘরের দুর্গন্ধ ও মশামাছি দমনের জন্য মাঝে মাঝে জীবাণুনাশক দ্বারা ধোয়া প্রয়োজন।

গবাদিপশুর বাসস্থান দুই ধরণের হতে পারেঃ ১· উন্মুক্ত বা উদাম ঘর ২· বাঁধা ও প্রচলিত ঘর।

বাঁধা ঘরের বৈশিষ্ট্যঃ এই পদ্ধতিতে গরুর গলায় দড়ি বা লোহার শিকল দিয়ে বেঁধে পালন করা যায়। গাভীর খাদ্য, পানি গ্রহণ এবং দুধ দোহন একই স্থানে করা যায়।

সুবিধাঃ বাঁধা থাকে বিধায় গাভীর দুধ দোহন সহজ হয়, প্রতিকূল আবহাওয়ায় পশু নিরাপদ থাকে, কৃত্রিম প্রজননের জন্য বেশ সুবিধাজনক, নির্ধারিত অল্প জায়গায় পশু পালন করা যায়।

অসুবিধাঃ এই পদ্ধতিতে ঘর তৈরি খরচ বেশি, পশুর সহজে ঘোরাফেরার ব্যবস্থা থাকে না, এতে পশুর ব্যয়াম না হওয়াতে বিভিন্ন ধরনের রোগ হবার সম্ভাবনা থাকে, একই জায়গায় দিনরাত্রি বাঁধা থাকে বলে মেঝে স্যাঁতস্যাঁতে থাকে।

বাঁধা ঘরের নকশাঃ এই পদ্ধতির গো-শালায় পশু সব সময় বাঁধা অবস্থায় থাকে। এজন্য গো-শালা যাতে সহজে পরিস্কার করা যায় সেদিকে লক্ষ্য রেখে ঘর তৈরি করা প্রয়োজন। প্রচলিত গো-শালা দুই ধরনের হয়-

একসারি বিশিষ্ট গো-শালাঃ অল্প সংখ্যক গবাদি পশুর জন্য একটি লম্বা সারিতে বেঁধে পালনের জন্য এই গো-শালা তৈরি করা হয়। প্রতিটি পশুকে পৃথক রাখার জন্য জিআইপাইপ দিয়ে পার্টিশন দেয়া হয়, পার্টিশনের পাইপ লম্বায় ৯০ সে·মি· এবং উচ্চতায় ৪৫ সে·মি· হওয়া প্রয়োজন, একটি গরুর দাঁড়াবার স্থান ১৬৫ সে·মি·, পাশের জায়গা ১০৫ সে·মি·, খাবার পাত্র ৭৫ সে·মি· এবং নালা ৩০ সে·মি· হওয়া প্রয়োজন, একই মাপে পশুর সংখ্যা অনুযায়ী জায়গা নির্ধারণ করে গো-শালা তৈরি করা হয়, গো-শালা হবে একচালা বিশিষ্ট ঘর, ঘরের ছাদ প্রায় ৩০০ সে·মি· উঁচুতে করতে হয়।

দুই সারি বিশিষ্ট গো-শালাঃ অল্প জায়গায় অধিক পশুপালনের জন্য এ ধরণের গো-শালা তৈরি করা হয়, এ ধরনের গো-শালায় পশুকে দুভাবে রাখা যায়, মুখোমুখি পদ্ধতি ও বাহির মুখ পদ্ধতি। মুখোমুখি পদ্ধতিতে দুই সারি পশু সামনাসামনি থাকে। দুইসারি খাবারের পাত্রের মাঝখানে ১২০ সে·মি· চওড়া রাস্তôা থাকে- যা পাত্রে খাবার দেবার জন্য ব্যবহার করা হয়, একটি গরুর জন্য দাঁড়ানোর জায়গা ৫·৫ ফুট, পাশের জায়গা ৩·৫ ফুট।

সুবিধাঃ একই সাথে দুইসারি পশুকে সহজে খাবার ও পানি সরবরাহ করা যায়, দুধ দোহনের জন্য অধিকতর আলো পাওয়া যায়, পশু নিজ জায়গায় স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে, পরিচর্যাকারী সহজে চলাফেরা করতে পারে।

একটি গাভীকে নিম্ন তালিকা অনুসারে খাদ্য সরবরাহ করতে হবেঃ কাঁচা ঘাস (সবুজ ঘাস) ২০-৩০ কেজি, দানাদার খাদ্য মিশ্রণঃ ১৮-২০% প্রোটিন সমৃদ্ধঃ ১ম ৩ কেজি দুধ উৎপাদনের জন্য- ০৩ কেজি, পরবর্তী প্রতি কেজি দুধ উৎপাদনের জন্য-০·৫ কেজি, লবণ-৫০-৬০ গ্রাম, পরিস্কার পানি-প্রয়োজন মত।

পরিচর্যাঃ গাভীর সঠিক পরিচর্যা না করলে উন্নত জাতের গাভী পালন করেও গাভীকে সুস্থ সবল উৎপাদনক্ষম রাখা সম্ভব হবে না। ফলে গাভী হতে কাঙ্ক্ষিত পরিমাণ দুধ, মাংস পাওয়া যাবে না এবং গাভী পালন অলাভজনক হবে।

দুধ দোহনঃ গাভীর দুধ দৈনিক ভোরে একবার এবং বিকালে একবার নির্দিষ্ট সময়ে দোহন করতে হবে। দুধ দোহনের পূর্বে গাভীর উলান ও দোহনকারীর হাত পরিস্কার পানি দিয়ে ভালভাবে ধুয়ে নিতে হবে।

প্রজননঃ গাভীর বংশানুক্রমিক গুণগতমান উন্নয়নের জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পিত প্রজনন ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। যে ষাড়ের মা, দাদী, নানী যত বেশি পরিমাণ দুধ দেয় তার বাচ্চার দুধ উৎপাদনের ক্ষমতা ততই বেশি হয়। তাই যখন গাভী গরম হবে তখন গুণগতমানসম্পন্ন ষাড়ের বীজ দ্বারা নিকটস্থ কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্র হতে গাভীকে প্রজনন করিয়ে নেওয়া প্রয়োজন।

খামারের রেকর্ড সংরক্ষণঃ খামারের লাভক্ষতি নিরূপণ আয়-ব্যয়ের সঠিক হিসাবের উপর নির্ভরশীল। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য পরিকল্পনা ও লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের বিয়য়ে মূল্যায়ন করা দরকার। খামারের উৎপাদিত পণ্যের হিসাব, ক্রয়, বিক্রয়, জন্ম, মৃত্যু এবং কৃত্রিম প্রজনন কার্যক্রমের জন্য সঠিক তথ্য রক্ষাকল্পে রেকর্ড সংরক্ষণ করা অত্যাবশ্যকীয়।

উন্মুক্ত বাসস্থানে নিম্নোক্ত হারে জায়গার প্রয়োজনঃ

পশুর ধরণ ঘরে প্রতি পশু স্থান প্রতি পশুর জন্য মুক্ত স্থান খাদ্যপাত্র
বাড়ন্ত বাছুর ২·৫-৩ বর্গ মিটার ৫-৬ বর্গ মিটার ৩৭-৫০ সেন্টিমিটার
গাভী ৩-৩·৫ বর্গ মিটার ৮-১০ বর্গ মিটার ৫০-৬০ সেন্টিমিটার
গর্ভবতী গাভী ১০-১২ বর্গ মিটার ১৮-২০ বর্গ মিটার ৬০-৭০ সেন্টিমিটার

-কৃষিবিদ সোহরাব জিসান

দেশি মাছ রক্ষার উপায়-২

দেশি মাছ রক্ষার উপায়-২






প্রথম পর্বে প্রকৃতির পরিবর্তনকে মেনে নিয়ে কীভাবে দেশি ছোট জাতের মাছের বংশ বৃদ্ধি করা যায় এ বিষয়ে আলোকপাত করেছিলাম। আমাদের ধানের উৎপাদন একদিকে যেমন বাড়াতে হবে অন্যদিকে ভিটামিনের চাহিদা পূরণের সর্বাত্মক উৎপাদনের চেষ্টা চালিয়ে যেত হবে। আমাদের দেশে ছিল এক সময় গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ। সেদিনের বাস্তôবতা আর বর্তমানের প্রেক্ষিত সবকিছু বিবেচনা করেই আমাদের এগোতে হবে। আগের ইতিহাসে যদি আমরা ফিরে যাই তাহলে দেখবো যে, আগে জনসংখ্যা ছিল অনেক কম। সে হিসেবে জমির পরিমাণ ছিল বেশি।


প্রচুর জলাশয়, ভূমি তখন অব্যবহৃত থেকে যেত। জলাশয়গুলোতে অবাধে মাছ বিচরণ করতো বছরের পর বছর। মানুষের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হত অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ ধানের ক্ষেত্রে বলা যায়, বর্তমানের চেয়ে ধানের উৎপাদন অতীতে অনেক কম হলেও শেরশাহ এর আমলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। এ কথাগুলো লেখার অর্থ হল অতীত ও বর্তমান প্রেক্ষিতের একটি বাস্তôবচিত্র তুলে ধরা। আমাদের এই বাস্তôবতাকে মেনে নিয়ে সামনের দিকে এগোতে হবে। আমাদের প্রাকৃতিক জলাশয় সংকুচিত হয়ে আসছে। সেজন্য এই অবস্থানের কথা চিন্তôা করেই আমাদের দেশিয় ছোট ছোট প্রজাতির মাছগুলো রক্ষার বা প্রজননের উদ্যোগ নিতে হবে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে মলা মাছ কীভাবে পুকুরে চাষ করতে হয় তা উলেস্ন্লখ করছি-
পুকুরে মলা মাছের চাষঃ পুকুরেই হবে মলা মাছের চাষ। আগে আমরা দেখতাম খালে-বিলে দল বেঁধে মলা মাছ চলাফেরা করতো। আর এরা ধরাও পরতো ঝাঁকে ঝাঁকে। ছোটবেলায় আমরা খুব মজা করে মলা মাছ মারতাম- বিশেষ করে ছিপজাল দিয়ে। কোন এক স্রোতের মুখে এই জাল ফেলে বসে থাকতাম। পানি একটু স্বচ্ছ হলে পরিস্কার দেখা যেত দল বেঁধে মলা মাছ আসছে। ঘাপটি মেরে বসে থাকতে পারলে পুরো মলা মাছের দলটিকে জালে উঠিয়ে ফেলা যেত।


পুরো দল মানে অনেক মাছ। এই মাছটি বর্তমানে বিপন্নের পথে। অথচ একটু চেষ্টা করলেই এই মাছটিকে আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব। মলা মাছের পুষ্টিগুণ ও ওষুধিগুণের কথা সবারই কম বেশি জানা আছে। মলা মাছ পুকুরেই ডিম দিয়ে থাকে। দরকার শুধু উদ্যোগের। একবার শুধু কিছু মলা মাছকে পুকুরে ছেড়ে দিলেই হল। এটা কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। মাস দুয়েক পর থেকেই মলা মাছ পুকুরে ডিম দিতে শুরু করে। একক চাষেও মলা মাছের সম্ভাবনা আছে। একক চাষের জন্য প্রথমে পুকুরে রটেনন দিয়ে অবঞ্চিত মাছ মেরে ফেলতে হবে। তারপর চুন দিয়ে পরিস্কার পানিতে পুকুর পূর্ণ করতে হবে। পানি ৩ ফুট রাখা বাঞ্চনীয়। এরপর আশপাশের যেকোন উৎস হতে কিছু মলা মাছের পোনা বা বড় মলা মাছ পুকুরে ছাড়তে হবে। জীবিত মলা মাছ পরিবহন করা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ।


তাই আশেপাশের যে কোন উৎস হতে খুব সর্তকতার সাথে মলা মাছ বহন করতে হবে। একবার মাছ স্টক হলেই হল। প্রজননের জন্য আর কিছুর প্রয়োজন নেই। মাসখানেক পর থেকেই মলা মাছ ডিম দিতে শুরু করবে। প্রথম দুইমাস কোন মাছ ধরা যাবে না। শুধু বংশ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে। দুইমাস পর থেকে প্রতি ১৫ দিন অন্তôর অন্তôর মাছ আহরণ করা যাবে। মাছ আহরণের সময় এমন জাল ব্যবহার করতে হবে যাতে শুধু বড় মলা মাছগুলো জালে উঠে আসে। আর ছোট মাছগুলো জালের ফাঁক দিয়ে পুকুরে চলে যায়। এভাবে প্রতি ১৫ দিন পর পর মাছ ধরা যাবে। মলা মাছের প্রচুর পরিমাণে প্রজননের জন্য অমাবস্যায় বা পূর্ণিমার রাতে পুকুরে শ্যলো দিয়ে পানি দেয়ার ব্যবস্থা করলে পর্যাপ্ত পরিমাণে বাচ্চা পাওয়া যাবে। খাবার হিসেবে শুধুমাত্র অটোকুঁড়া ব্যবহার করা উচিত। খাবার পুকুরে ভাসিয়ে দিতে হবে। অন্য খাবার ব্যবহার করলে পুকুরের পানির রঙ সবুজ হয়ে যেতে পারে। পানি বেশি সবুজ হলে মলা মাছের ডিমপাড়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে বা বাচ্চা দেয়ার হার কমে যেতে পারে। কারণ, মলা মাছ স্বচ্ছ পানিতে বাস করতে ও প্রজনন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এ জন্য খাবার হিসেবে অটোকুঁড়া দিলে ভাল। অটোকুঁড়া পানিতে ভেসে থাকে বিধায় সমস্তô খাবার মাছে খেয়ে ফেলতে পারে। তাই পানিও পরিস্কার থাকে।

মলা মাছের বাজারজাতঃ মলা মাছ একটি নরম প্রকৃতির মাছ। পুকুর থেকে মাছ আহরণের পর মলা মাছকে বেশিক্ষণ স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখা যায় না। ২ থেকে ৩ ঘন্টা পর থেকেই মলা মাছ পচে যাওয়া শুরু করে। তাই মলা মাছকে পুকুর থেকে ধরেই বরফ দিতে হবে। এভাবে মাছ সংরক্ষণ করলে ১২ থেকে ১৮ ঘন্টা পর্যন্তô টাটকা অবস্থায় রাখা যায়। এ সময়ের মধ্যে দেশের যে কোন প্রান্তে বাজারজাত করা সম্ভব।

মলা মাছের উপযোগিতাঃ মলা মাছ চাষের খাদ্য খরচ কম। পোনা কিনতে টাকার দরকার হয় না এবং বাজারমূল্য উচ্চ হওয়ার কারণে বাণিজ্যিকভিত্তিতে চাষ করা যেতে পারে।

- এ· কে· এম· নূরুল হক
কৃষিক্ষেত্রে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত




শাইখ সিরাজ
ইউরিয়া ছাড়া তিনটি সারের দাম অর্ধেক কমেছে। সারের দাম কমার এই হার সত্যিই এক বিরল ঘটনা বটে। আসন্ন বোরো মৌসুমকে সামনে রেখে নতুন নির্বাচিত সরকারের এ এক যুগান্তôকারী পদক্ষেপ। গত ১৪ জানুয়ারি কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী ও শিল্পমন্ত্রী যৌথ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে এই ঘোষণা দিয়ে সত্যিই দেশের কৃষকের পুঞ্জিভূত প্রত্যাশা পূরণ করেছেন। তবে এখানেই শেষ নয়, সময়মতো সারের যোগান নিশ্চিত করা এবং কৃষকের অন্যান্য প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে তোলার ক্ষেত্রে সরকারের ধারাবাহিক কর্মতৎপরতা অনুকূলে থাকলে কৃষক একটি নতুন সম্ভাবনার দিকে এগিয়ে যেতে পারবে। ইউরিয়া ব্যতিত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সার টিএসপি, এমওপি ও ডিএপি সারের দাম অর্ধেক কমানোর পেছনে মূল লক্ষ হচ্ছে বাজারে খাদ্যপণ্যের মূল্য সহনীয় রাখা। কৃষক যদি কম মূল্যে সার কিনতে পারে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনতে পারবে, সে ক্ষেত্রে কৃষক পর্যায়ে উৎপাদিত পণ্যের বিক্রয় মূল্যও থাকবে কম। যার প্রভাব থাকবে ভোক্তা পর্যায়ের খুচরা বাজার পর্যন্ত। সারের দাম কমানোর ঠিক দুদিন আগেই সরকার ডিজেলের দাম লিটারপ্রতি ২ টাকা কমিয়ে তাৎক্ষণিক একটি চমক দিয়েছে বটে, কিন্তু এর প্রভাব কৃষক পর্যায়ে পড়বে না।

২০০৪-০৫ অর্থবছরে ইউরিয়া ছাড়া বাকি তিন ধরণের সারে সরকারের ভর্তূকি হার ছিল ২৫ শতাংশ, আর ঠিক এই অর্ধেক মূল্য কমানোর আগে সরকারের ভর্তূকির হার ছিল ১৫ শতাংশ। আর এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে সরকার ভর্তূকি দিচ্ছে ৫৫ শতাংশ, অর্থাৎ ২ হাজার ৭’শ ৫৭ কোটি টাকা। এই ভর্তূকির সুফল কৃষক পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার জন্যও সরকার দূরদর্শী পরিকল্পনা নিয়েই এগুচ্ছে বলে ঘোষণা এসেছে। এই প্রক্রিয়ায় সফলতা অর্জন করলে তা কৃষকদের দীর্ঘদিনের বঞ্চনা ঘোচাবে বলেই বিশ্বাস করছি। কারণ গত ছয় বছর যাবৎ জাতীয় বাজেটের আগে কৃষকদের সঙ্গে প্রাক-বাজেট আলোচনা করতে গিয়ে যে বিষয়টি সর্বাগ্রে পেয়েছি তা হচ্ছে কৃষকদের তথ্য প্রাপ্তির অভাব। অর্থাৎ কৃষক জানেন না যে, সার কিংবা সেচ বাবদ সরকারের তরফ থেকে কত ভর্তূকি দেয়া হয়, কীভাবে দেয়া হয়? সার তারা কেনেন ভর্তূকি দরে, কিন্তু এই তথ্যটুকু না জানার কারণে তাদের প্রতি রাষ্ট্রের কিংবা সরকারের দায়িত্বের জায়গাটি অস্পষ্টই থেকে যায়। আবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখেছি সেচখাতে ডিজেল কিংবা বিদ্যুতে সরকারের যে ভর্তূকি ও রেয়াত সুবিধা দেয়া হয় তা সেচ পাম্প মালিক পর্যন্তô পৌঁছে। কৃষক মূল্য পরিশোধের বেলায় ভর্তূকি সুবিধার কিছুই পান না। এই কারণে কৃষির সকল স্তôরে বছরব্যাপী কৃষকদের বঞ্চনার পাল্লা ভারী হতেই থাকে। এবার সরকার ভর্তূকির সুফল যদি চুলচেরা হিসাবে কৃষকের ঘরে পৌঁছে দিতে পারে তা হবে অনেক বড় একটি অর্জন।

গত দুই বছরে লাফিয়ে লাফিয়ে সারের দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে কৃষক বারবারই এক অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। ২০০৭ সালের শেষের দিকে সিডর-এর মত প্রাকৃতিক দুর্যোগ তার আগে দুইবারের বন্যা এত কিছুর পর খাদ্যশস্যের ঘাটতি পূরণের এক কঠিন চ্যালেঞ্জ নিতে হয়, এই চ্যালেঞ্জের মধ্যেও সারের চড়ামূল্য পরিশোধ করতে হয়েছে কৃষককে। তারপরও কৃষক নিশ্চিত করেছে বাম্পার ফলন। এটি সত্যিই এক বড় ঘটনা। একথা অস্বীকার করা যাবে না যে, গত দুই বছর তত্ত্বাবধায়ক সরকার কৃষকের খুব কাছাকাছি থেকে ফসলের বেশি উৎপাদনের লক্ষে যথেষ্ট আন্তôরিকতা দেখিয়েছে, কিন্তু সারের মূল্য কমাতে পারেনি তারা। তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসেবে হয়তো এমন একটি সিদ্ধান্তô গ্রহণ তাদের কাছে সহজ ছিল না। এই সময়েও দেশের বিভিন্ন এলাকায় কৃষিক্ষেত্রে সরকারের আনুকূল্য নিয়ে রাজনৈতিক কোন বিতর্ক ছিল না, এটিও এদেশের জন্য অত্যন্তô ইতিবাচক দিক। হয়তো সে কারণেই অনেক প্রতিকূল অবস্থার ভেতরও সরকারের আন্তôরিকতাকে তারা কাজে লাগাতে সমর্থ হয়েছে। গত এক দেড় বছর যাবৎ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সারের চড়ামূল্যের কারণে কৃষককে সত্যিই এক দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়তে হয়েছে। আলু চাষের সমৃদ্ধ ক্ষেত্র রাজশাহী ও রংপুরের অনেক কৃষককে আলু রোপণ মৌসুমে ফলন নিয়ে অনিশ্চয়তায় পড়ার চিত্র যেমন দেখেছি, একইভাবে দেখেছি মুন্সিগঞ্জ অঞ্চলে শুধু সারের চড়া মূল্যের কারণে আলু চাষ থেকে অনেক কৃষককে সরে গিয়ে ক্ষতিকর তামাক চাষের দিকে ঝুঁকতে। কারণ, তামাক চাষের ক্ষেত্রে কৃষকের সারের নিশ্চতয়তা আছে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে (সারের মূল্য কমানোর ঠিক দুই দিন আগে) চট্টগ্রামের বিভিন্ন এলাকায় কৃষকের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, যে এলাকাগুলো কৃষিতে দারুণ সমৃদ্ধ সেখানেও বিরাজ করছে এক হতাশা।

সীতাকুণ্ডের ধর্মপুর গ্রামের কৃষক মানিক চন্দ্র নাথ বলছিলেন, প্রয়োজনমাফিক টিএসপি প্রয়োগ করা হলে যে সীমের ডগায় ১৫ থেকে ২০টি করে সীম ধরতো, সার প্রয়োগ না করার কারণে সেখানে সীম এসেছে ৮ থেকে ৯টি। টিএসপি প্রয়োগ না করতে পেরে উৎপাদনের এই দশা। এই পরিস্থিতি দেশের সব এলাকার। সবাই তাদের প্রধান সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করেছে সারের মূল্য কমানোর কথা। দিন দশেক আগে ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার এক গ্রামে গিয়ে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলেছি, তারা স্পষ্টতই বলেছেন- সারের মূল্য কমালে চালের দাম কমানো যাবে। এমন চিন্তা দেশের সব এলাকার কৃষকের। সত্যিই কৃষকের এই চিন্তôাই মূল্যায়িত হয়েছে তিন ধরণের সারের মূল্য অর্ধেক কমানোর সিদ্ধান্তে। বোরো মৌসুমকে সামনে রেখে সরকারের এই ঘোষণার পরিপূর্ণ সাফল্য আসবে ইউরিয়ার পরিপূর্ণ যোগান নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে। আবহাওয়া ও প্রকৃতি অনুকূলে থাকলে আর ইউরিয়ার যোগান নিশ্চিত করা গেলে বোরোতেও আরও একটি বড় উৎপাদন সাফল্য আসবে বলে আশা করি। আজ সারের মূল্য কমানোর বিষয়টিকে যদি সরকারি বিনিয়োগও ধরা হয়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই তিন মাসের মধ্যেই লভ্যাংশসহ তা ফেরত পাওয়া যাবে। দূরদর্শী সিদ্ধান্তô গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী তথা কৃষিমন্ত্রী ও শিল্পমন্ত্রীকে জানাই আন্তôরিক ধন্যবাদ।

কৃষিতে বছরে আয় ৩০ লক্ষ টাকা

কৃষিতে বছরে আয় ৩০ লক্ষ টাকা






মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কাগাবলা ইউনিয়নের রামপুর গ্রাম। এ গ্রামের আব্দুল আজিজ টাকার জন্য এক সময় লন্ডনে থাকতেন। পাশাপাশি শ্রীমঙ্গল শহরে পর্যটকদের জন্য টি-টাউন রেস্ট হাউজ নির্মাণ করে রেষ্ট হাউস ব্যবসায় একনিষ্ঠভাবে জড়িত ছিলেন। কিন্তু অযত্নে অবহেলায় দেশের মাটিতে পড়েছিল তার পৈত্রিক অনেক অনাবাদি জমি। একটা সময় তিনি অনুভব করলেন পতিত জমি কীভাবে কাজে লাগানো যায়। সময়টা ছিল ৪ থেকে ৫বছর পূর্বে। দেশের মাটিতে এসে মাটির সদব্যবহারের জন্য ব্যস্তô হয়ে পড়েন তিনি। আব্দুল আজিজ স্থানীয় কৃষি অফিসের পরামর্শে তার পতিত জমিতে ভিত্তি বীজ (মাদার সীড) চাষের প্রদক্ষেপ নেন এবং প্রথম বছরই তিনি উৎপাদনে সফল হন।

সফলতার অগ্রযাত্রায় এক পর্যায়ে সরকারই তার কাছ থেকে ভিত্তি বীজ কিনে সংরক্ষণ করে রাখে। এরপর থেকে তার উৎসাহ বেড়ে যায়। নেশা জন্মে যায় কৃষি কাজে। বিভিন্ন স্থান ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করতে থাকেন একের পর এক নতুন ফর্মূলা। ফর্মূলা বাস্তবায়নে সর্বশেষ তিনি এ বছর জৈব সার ব্যবহার করে বিগত বছরগুলোর চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ বেশি ফলন পান। তিনি জানান, বিগত সময়ে কিয়ার প্রতি ২১শ টাকার সার ব্যবহার করে যে ফলন পেয়েছেন এ বছর জৈব সার ব্যবহার করে ফলন হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। শ্রীমঙ্গল টি-টাউন রেষ্ট হাউসের স্বত্ব্যাধিকারী আব্দুল আজিজ প্রথম বৃহৎ আকারে ভিত্তি বীজ উৎপাদনে মৌলভীবাজার জেলায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।

তিনি একই সাথে বীজ ধান, সৃজনাল সবজি চাষ, বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ, বনজ ও ঔষধি গাছের বাগান করে প্রায় শতাধিক বেকার লোকের কাজেরও সুযোগ করে দিয়েছেন। এ সকল খামার থেকে তিনি বছরে আয় করছেন ২৫ থেকে ৩০ লক্ষ টাকা। তাঁর সংগ্রহে প্রায় আড়াইশ প্রজাতির গাছ রয়েছে। এর মধ্যে বাউকুল, আপেল কুল, ঢাকাইয়া ত্রিবিড় বড়ই, সুবর্ণা আম, পাকিস্তôানী বারমাসী আম, বোম্বে আম, রাজশাহী আমড়া, থাইলেন্ডী বারমাসী আমড়া, ছাতিকী কমলা, থাইলেন্ডী জাম, তিন প্রজাতির পেয়ারা, বারমাসী কাঁঠাল, ভাওয়ালী কাঁঠাল, সাতকড়া, আগর গাছ, থাইলেন্ডী নারকেল, দেশি নারিকেল, সুপারী, বারমাসী জাম্বুরা, আঙুর, কাগজী লেবু, কুয়েতী খেজুর, লাম্বু গাছ, চামল, সেগুন, একাশী, মেহগনি, শিল কড়ই, তেজপাতা, নিম, আমলকি, হরতকি, লুকলুকি, জলপাই, কদম, তেঁতুল, দারুচিনিসহ আরও শতাধিক।

এবারে তার উৎপাদিত ধানের জাতগুলো হল বি· আর-১১ ও ৩৪, নাজির শাইল, কালা বিড়ইন, সাদা বিড়ইন। তাঁর এ বাম্পার ফলনে উৎফুল্ল এলাকাবাসী। আব্দুল আজিজের সাফল্য দেখে অনেকেই আগামী মৌসুমে জৈব সার ব্যবহারের চিন্তা করছেন।

বিগত বছরে তিনি ২ হাজার মণ বীজ ধান উৎপাদন করেছেন। তার এই উৎপাদনে ব্যয় হয়েছিল ৬ লক্ষ টাকা। এ ধান বিক্রি করেছেন ২১ লক্ষ টাকা। এতে তার লাভ হয়েছে ১৫ লক্ষ টাকা। এর মধ্যে সরকারই তার কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন এক হাজার মণ ধান। যা সরকারের সংরক্ষণে রয়েছে। চলমান মৌসুমেও তাঁর উৎপাদনের লক্ষমাত্রা ছাড়িয়ে গেছেন। ইতিমধ্যে তিনি প্রায় এক হাজার মণ বীজ ধান উৎপাদন করেছেন। আব্দুল আজিজ আশা করছেন, একই জায়গায় আরও প্রায় আড়াই হাজার মন ধান উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এছাড়াও তিনি তার পতিত জমিতে সৃজনাল সবজি চাষ করে বছরে প্রায় ২ লক্ষ টাকা আয় করেন। এসব কিছুর পাশাপাশি তিনি তার বাড়ির আশেপাশে বিভিন্ন প্রজাতির ফলজ, বনজ ও ঔষধি বৃক্ষসহ প্রায় শতাধিক প্রজাতির বৃক্ষ রোপণ করেছেন।

- বিকুল চক্রবর্ত্তী, মৌলভীবাজার

আসছে দুর্যোগ সহনশীল ধানের জাত

আসছে দুর্যোগ সহনশীল ধানের জাত








বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের শতকরা ৮০ ভাগ মানুষই কৃষির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। জীবিকা নির্বাহের জন্য এ দেশের মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য হচ্ছে ধান। প্রতি বছর বাংলাদেশের সব জেলাতে প্রচুর পরিমাণে ধান উৎপাদন হয়। তবে তা আমাদের চাহিদার তুলনায় কম। ফলে থেকে যাচ্ছে ঘাটতি। জলবায়ুগত কারণে কৃষকরা ধানচাষে যেমন সুযোগ-সুবিধা পায় তেমন নানা রকম অসুবিধার মধ্যেও তাদের পড়তে হয়। ২০০৭ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ ও ২০০৮ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘রেশমী’ এর আঘাতে আমন ধানের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। এ ছাড়াও ৮৮, ৯৮ ও ২০০৭ সালের দু’দফা বন্যায় ধানসহ সব ধরণের ফসলের অবর্ণনীয় ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয় কৃষকদের।

যার ফলে কৃষি ও কৃষকের উপর নেমে আসে অপ্রত্যাশিত প্রতিবন্ধকতা। অপরদিকে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় কৃষিক্ষেত্রে সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন সমস্যা। বিশ্বব্যাপী কৃষির মহামন্দার সময় ফিলিপাইনের আন্তôর্জাতিক ধান গবেষণা ইনষ্টিটিউট বিশ্বকে দেখাল এক আলোর ইশারা। তারা পরিবেশবান্ধব, অধিক ফলনশীল ও দুর্যোগ সহনশীল ধান উদ্‌ভাবন করেছে যা ২০০৯ সাল থেকে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনের কাজ শুরু করবে বাংলাদেশের কৃষকরা। এ ধরণের ধান চাষে আমাদের কৃষকরা বেশ লাভবান হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। এ ধান ১৫ দিন পানির নিচে থাকলেও তেমন কোন ক্ষতি হবে না। বন্যা, অতিবৃষ্টি ও ঘূর্ণিঝড়ে সহজে নষ্ট হবে না বলে বিজ্ঞানীরা জানান। বাংলাদেশের জলবায়ুতে এ জাতের ধান চাষ অত্যন্তô উপযোগী বলে মনে করেন আন্তôর্জাতিক ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা।


ইসমাইল হোসেন

শনিবার, ১৭ জানুয়ারী, ২০০৯

আলু ও টমেটোর নাবী ধসা রোগ

আলু ও টমেটোর নাবী ধসা রোগ






কয়েক দিন ধরে বাংলাদেশে বিশেষ করে উত্তবাঞ্চল কুয়াশায় ঢাকা পড়ে আছে। সারা দিন একবারো সূর্যের দেখা মেলে না। তাপমাত্রা কমে গেছে স্বাভাবিকের চেয়েও কম। এই আবহাওয়ায় মাঠের ফসল, বিশেষ করে আলু ও টমেটোতে দেখা দিয়েছে মড়ক রোগ। রোগটি আসলে লেট ব্লাইট বা নাবী ধসা। দিনে-রাতে কুয়াশা থাকায় তাপমাত্রা কমার পাশাপাশি আর্দ্রতাও বেড়ে যাওয়ায় এই রোগের জীবাণু দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। সপ্তাহ খানেক পর দিনে কুয়াশা কেটে যাওয়ার পর রোদ দেখা দিলেও রাতে আবার কুয়াশা পড়ায় মড়ক রোগের জীবাণুর বৃদ্ধির পক্ষে অনুকূল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। উত্তরাঞ্চলসহ সারা দেশের আলু ও টমেটো ক্ষেতে এবার এই রোগ যেভাবে ছড়িয়ে পড়েছে তাতে এখনই যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে চাষি ভাইয়েরা সমস্যায় পড়বেন। তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মাঠের সমস্যা দেখে অনেক চাষি একই ক্ষেতে একাধিক ছত্রাকনাশক পর পর ব্যবহার করছেন। এতে কাজ হচ্ছে না। হওয়ার কথাও নয়। আবার অনেক স্থানের চাষিরা কৃষি অফিস বা কৃষিবিদদের সাথে যোগাযোগ ছাড়াই দোকান থেকে নিজেরাই বা দোকানদারদের পরামর্শে ভুল ছত্রাকনাশক কিনে ব্যবহার করে প্রতারিত হচ্ছেন। আসলে নাবী ধসা রোগ হওয়ার আগের পরিবেশ এবার আবহাওয়ার কারণেই তৈরি হয়েছিল।
সে কারণে কুয়াশা দেখা দেয়ার সাথে সাথে যারা মেনকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক ৩ থেকে ৪ দিন পর পর ব্যবহার করেছেন তাদের ক্ষেত কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্ত এই সময়ে যারা কোনো ছত্রাকনাশক ব্যবহার করেননি, এবং গাছে সমস্যা দেখা দেয়ার পর মেনকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক ব্যবহার করেছেন তাদের বেলায় এই ছত্রাকনাশক কোনো কাজ করেনি। কারণ একবার রোগাক্রান্ত হলে মেনকোজেব কোনো কাজ করে না। তখন অন্য গ্রুপের ছত্রাকনাশক (যেমন, মেনকোজেব+ মেটালাক্সিল বা প্রপিনেব+ আইপ্রোভেলিকার্ব বা ফেনামিডন+ মেনকোজেব) ব্যবহার করতে হয়। এ জন্য সমস্যা দেখা দিলে প্রথমেই নিকটস্থ কৃষি অফিসে যোগাযোগ করা উচিত।
এখানে লেট ব্লাইট বা মড়ক রোগের কারণসহ লক্ষণ ও নিয়ন্ত্রণের কিছু বিষয় উল্লেখ করা হলো।
রোগের কারণ ও লক্ষণঃ এক ধরনের ছত্রাকের কারণে রোগটি হয়। রোগের প্রাথমিক অবস্থায় পাতা, পাতার বোঁটা, ডগা ও কাণ্ডে ছোট ছোট পানি ভেজা আঁকাবাঁকা দাগ পড়ে। ধীরে ধীরে এই দাগ প্রথমে বাদামি ও পরে কালো রঙ ধারণ করে। এরপর দাগ আরো বড় হয়ে সব পাতা, ডগা ও কাণ্ডের চার দিকের বেশ কিছু অংশ ঘিরে ফেলে। আক্রান্ত দাগের চার দিকে ফ্যাকাশে সবুজ ও বাদামি রঙের বলয় দেখা যায়। পাতার নিচে সাদা সাদা গুঁড়োর মতো জীবাণু দেখা দেয়। এই জীবাণু সামান্য বাতাসেই উড়ে গিয়ে অন্য সুস্থ গাছের পাতা ও ডগা সংক্রমণ করে। বাতাসের আপেক্ষিক আর্দ্রতা বেশি (৯০-১০০%) থাকলে ২ থেকে ৩ দিনের মধ্যেই ক্ষেতের অধিকাংশ গাছ আক্রান্ত হয়ে পড়ে। মারাত্মকভাবে আক্রান্ত ক্ষেতে এক ধরনের বিশেষ গ বা পোড়া গ পাওয়া যায়। ক্ষেত দেখে মনে হয় সমস্ত আলুগাছ পুড়ে গেছে। টমেটোর ফল আক্রান্ত হলে বোঁটার কাছাকাছি জায়গা থেকে কালো দাগ পড়ে এবং পচন শুরু হয়।
উপযোগী পরিবেশঃ রাতের তাপমাত্রা ১০ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং আপেক্ষিক আর্দ্রতা ৯০-১০০% হলে ছত্রাক খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়। রোগ সংক্রমণের পর ২১ থেকে ২৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় রোগ আরো বৃদ্ধি পায়।
বিস্তারঃ আক্রান্ত টমেটো বা আলু বীজের মাধ্যমে এই ছত্রাক পরের বছরে রোগ ছড়ায়। অনেক সময় আক্রান্ত টমেটো বা আলুগাছ থেকেও এই রোগ সুস্থ টমেটো বা আলুগাছে ছড়ায়। এই রোগের বীজাণু বা স্পোর বাতাস ও পানির ছিটার মাধ্যমে ক্ষেতের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ে।
নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনাঃ আক্রান্ত ক্ষেত থেকে বীজ না নেয়া উচিত। প্রত্যয়িত বীজ ব্যবহার করতে হয়। ক্ষেত সব সময় আগাছামুক্ত রাখতে হয়। ফসল তোলার সময় আক্রান্ত গাছ ও পাতা যেন টিউবার বা কন্দের সাথে না লাগে সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হয়। রোগাক্রান্ত সম্পূর্ণ আলুগাছ সংগ্রহ করে পুড়িয়ে বা মাটিতে পুঁতে ফেলতে হয়। রোগাক্রান্ত আলুবীজও মাটিতে পুঁতে ফেলা উচিত। আক্রান্ত ক্ষেতের আলুগাছ সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাওয়ার পর আলু তুললে পাতায় অবস্থিত ছত্রাক মরে যায়, ফলে টিউবার বা কন্দ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশ কমে যায়। গাছের গোড়ার মাটি উঁচু করে দিলে মাটির নিচের আলুকে রোগ-বীজাণু থেকে রক্ষা করা যায়। বৃষ্টির পর বা ভেজা মাটিতে কখনো আলু তোলা উচিত নয়, এতে পাতা ও মাটি থেকে আলু সংক্রমিত হতে পারে। আলু তুলে ফেলার পর পরিত্যক্ত অংশগুলো একত্র করে পুড়িয়ে ফেলতে হয়। আগাম জাতের আলু চাষ করলে অনেকাংশে এই রোগ এড়ানো যায়। যেসব এলাকায় প্রতি বছর বা প্রায়ই এই রোগের প্রকোপ দেখা দেয় সে সব এলাকায় আলুর গাছ ৮ থেকে ১০ সেন্টিমিটার হলেই ২০ থেকে ২২ দিন পর পর বোর্দো মিশ্রণ বা মেনকোজেব বা কপার অক্সিক্লোরাইড জাতীয় ছত্রাকনাশক স্প্রে করতে হয়। আক্রান্ত ক্ষেতে যথাসম্ভব সেচ প্রদান ব রাখতে হয়। সুষম সার ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
টমেটো বা আলু ক্ষেত আক্রান্ত হলে মেনকোজেব জাতীয় ছত্রাকনাশক প্রয়োগ করে কোনো ফল পাওয়া যায় না। এ ক্ষেত্রে অ্যাক্রোবেট এমজেড (ডাইমেথোমর্ফ + মেনকোজেব) অথবা মেলোডি ডিউ (প্রোপিনেব + আইপ্রোভেলিকার্ব) অথবা রিডোমিল গোল্ড এমজেড (মেটালাক্সিল এম + মেনকোজেব) আলু ক্ষেতে স্প্রে করতে হয়। স্প্রে করার সময় পাতার উভয় দিকসহ সম্পূর্ণ গাছ ভিজিয়ে দিতে হয়। এই ছত্রাকনাশকগুলোর যেকোনো একটি ৭ দিন পরপর ২ থেকে ৩ বার স্প্রে করতে হয়। যদি কুয়াশা দীর্ঘায়িত হয় তাহলে যত দিন কুয়াশা থাকে তত দিন সপ্তাহে ২ বার স্প্রে করা ভালো।


খোন্দকার মেসবাহুল ইসলাম

পান চাষে নবজাগরণ

পান চাষে নবজাগরণ






শীত নেমেছে। কখনো মেঘলা, কখনো রোদ। তবে তাতে ঠাণ্ডা কিছুমাত্র কমেনি। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় পান বরজের ভেতর পানগাছের লতাগুলোও যেন হিম হয়ে আছে। নতুন কোনো পাতা ছাড়ছে না, লতাগুলো আড়মোড়া ভেঙে বরজের ছাউনি ছুঁতে মোটেই ব্যস্ত নয়। বরং শীতে পাতাগুলো হয়ে গেছে ছোট, হলদে ভাবও ধরেছে। কোনো কোনো বরজে এখনো রেশ রয়ে গেছে লতা আর গোড়া পচা রোগের। বরজের মধ্যে কোনো কোনো পিলির (সারি) অর্ধেক গাছ এ রোগে মরে গেছে। এক কথায় শীতে বেশ কাবু করে ফেলেছে পানগাছগুলোকে। মহেশপুরে বেশ কয়েকটি বরজে গিয়ে পানগাছের এরূপ কাহিল চিত্র চোখে পড়ল। পানচাষিরা বললেন, প্রতি বছরই শীত এলে পানের এমন দশা হয়। এটাই না কী নিয়ম। শীতের পর বসন্ত এলে গাছ এ সমস্যা কাটিয়ে উঠবে, বোশেখ থেকে শুরু হবে নতুন পাতা।
কিন্তু মহেশপুর থেকে ঘুরে গিয়ে যখন খুলনার দিঘলিয়া উপজেলায় পৌঁছলাম তখন দেখলাম ঠিক উল্টো চিত্র। কোথায় পাতা হলদে হয়ে যাওয়া শীর্ণ লতা, আর কোথায় রোগ? বরং প্রতিটি পানগাছ যেন টগবগে যুবক। ইয়া বড় বড় সবুজ পাতা, মোটা মোটা শক্ত লতা। শীতকে গাছগুলো যেন থোড়াই কেয়ার করছে। উপজেলার গাজীরহাট ইউনিয়নের আমবাড়িয়া গ্রামের পানচাষি মহানন্দ বিশ্বাস বললেন, তার ১৫ কাঠার একটি পানবরজ থেকে ভাদ্র থেকে অগ্রহায়ণ, এ চার মাসে ৭০ হাজার টাকার পান বিক্রি হয়েছে। শীতে পাতার উৎপাদন কম ঠিকই, কিন্তু দাম ভালো।


প্রতি কুড়ি পান এখন প্রায় ৫ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ রকম দাম আগে কখনো পাওয়া যায়নি। মাত্র কুড়িটা পানের দাম পাঁচ হাজার টাকা! স্রেফ গুল। কিন্তু পানের হিসাবটা আলাদা। চারটা পানে হয় এক গণ্ডা, ২০ গণ্ডায় ১ পণ, ৬৪ পণে ১ কুড়ি। এ হিসাব শুনে সে ভুল ভাঙল। তার মানে প্রতিটি কাঁচা পান প্রায় এক টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। তিনি আশা করছেন আগামী আষাঢ়-শ্রাবণ পর্যন্ত আরো অন্তত ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার পান বিক্রি হবে। অর্থাৎ মাত্র ১৫ কাঠা জমিতে পানের বরজ করে বছরে লক্ষাধিক টাকা মুনাফা। আর কোন ফসল হয় শুনি? মহানন্দ বাবুর মতো আরো অনেক পানচাষিরও ওই একই জিজ্ঞাসা। শুধু তার বরজই নয়, সজল মণ্ডল, জ্ঞানেন মণ্ডল প্রমুখ পানচাষির মুখেও এখন হাসি ফুটেছে। তাদের বরজের অবস্থাও বেশ ভালো, ভালো দাম তারাও পাচ্ছেন। দিঘলিয়া উপজেলার আরো কয়েকটি এলাকার পানচাষিরা জানালেন, এ বছর তাদের বরজগুলোতে যেন নবযৌবন এসেছে। এত ভালো যে বরজের পানগাছ হতে পারে সে ধারণা তাদের আদৌ ছিল না। তাই তারা ভীষণ খুশি। নতুন উদ্যমে আগামীতে আরো নতুন বরজ তৈরি করতে আগ্রহী তারা। কেউ কেউ বললেন, তাদের বেশ কয়েকটা পানবরজের অবস্থা এমন খারাপ হয়ে গিয়েছিল যে তারা এক রকম পান চাষের আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। কিন্তু বিশেষ ব্যবস্থাপনা করে এখন সেসব বরজের পানগাছও হাসছে। প্রায় মরে যাওয়া গাছগুলো আবার সতেজ-সবল হয়ে উঠেছে।
কিন্তু পান চাষে এই নবজাগরণের রহস্য কী? জিজ্ঞেস করতেই পানচাষি মহানন্দ বিশ্বাস বললেন, আগে রাসায়নিক সার আর নানারকম মেডিসিন দিয়ে বরজের যে সর্বনাশ করেছি এখন সে ভুল আর আমরা করছি না। পানের বরজে শুধু জৈবসার দিলেই যে এমন ভালো কাজ হয় তা কে জানত? তিনি জানান, ২০০৬ সালে তিনি এ বরজটি গড়ে তোলেন। সে সময় ১৫ কাঠার এ পানের জমিতে ২১০ কেজি খৈল ও ২০০ কেজি গোবর সার দিয়ে জমি চাষ করেন। আষাঢ় মাসে লতা রোপণের মাসখানেক পর সে জমিতে সারির মাঝে আবার ৪০ কেজি সরিষার খৈল চাপা দেন। বছরে পাঁচ থেকে ছয়বার খৈল চাপা দেন। এভাবে প্রথম বছর কেটে যায় এবং পানগাছগুলো লতিয়ে বড় হয়। কিন্তু এ বছর খৈলের সাথে সমাধান জৈবসার বাজার থেকে কিনে একইভাবে পিলির মাঝের মাটিতে মিশিয়ে সেই মাটি গোড়ার লতার ওপর তুলে দেন। এতেই যেন বেশি কাজ হয়। বিশেষ করে আশ্বিনে ও চৈত্রে তিন বস্তা খৈলের সাথে দুই বস্তা অর্থাৎ ১০০ কেজি সমাধান জৈবসার ব্যবহার করে যেন গাছের চেহারা বদলে যায়। গত বছরের তুলনায় এ বছরের পাতার রঙ, আকার অনেক ভালো। এ জন্য দামও বেশি পাওয়া যাচ্ছে। তিনি বলেন, গাজীরহাট ও শিরোমণিরহাটে পান বেচতে নিয়ে গেলে সবাই বলে, তার পানই হাটের সেরা। স্থানীয় জৈবসার বিক্রেতা মন্মথ বাবু বলেন, এখন মহানন্দের মতো আরো অনেকে পানবরজে শুধু জৈবসার ব্যবহারে সুফল পাওয়ায় জৈবসারের বিক্রি বেড়ে গেছে। সমাধান জৈবসার উৎপাদনকারী শেখ গোলাম সারোয়ার বলেন, ‘শহরের বাসাবাড়ির আবর্জনা সংগ্রহ করে পচিয়ে এই জৈবসার তৈরি করা হয়। তবে পানের বিশেষ বিশেষ পুষ্টি উপাদানের চাহিদার দিকে লক্ষ রেখে সেই জৈবসারে পুষ্টি উপাদানের সমন্বয় ঘটানোর ফলে চাষিরা অধিক সুফল পাচ্ছেন।’
তবে উপজেলা কৃষি অফিসার মোঃ হাফিজুর রহমান বলেন, ‘দিঘলিয়া উপজেলাতে প্রায় ৩০০ হেক্টর জমিতে পান চাষ হচ্ছে। পানচাষিরা প্রচুর বিনিয়োগ করেন। পান একটি দীর্ঘমেয়াদি ফসল বিধায় এর নানা পর্যায়ে যত্নের দরকার হয়। তাই রাসায়নিক সারের চেয়ে জৈবসার ব্যবহারে বরজের আয়ু বাড়তে পারে। তবে এ বিষয়ে আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রয়োজন আছে।’ সে যাই হোক, পান যেহেতু সরাসরি কাঁচা পাতা চিবিয়ে খাওয়া হয়, তাই কোনো রকম রাসায়নিক ব্যবস্থাপনা ও বিষাক্ত বালাইনাশক ব্যবহার না করে জৈব পদ্ধতিতে পান চাষের ওপর জোর দেয়া খুব দরকার।



মৃত্যুঞ্জয় রায়

রবিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০০৯

এই শীতে খেজুরের রস ও গুড়

এই শীতে খেজুরের রস ও গুড়


ঋতুচক্রের পাখায় ভর করে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে এখন শীতকাল। শুরু হয়েছে শীত-পার্বণের মেলা। চারিদিকে পিঠা-পায়েস খাওয়ার পড়েছে ধুম। আছে শীতের সকালে খেজুর রস আর পাটালি গুড়। সে নানা বৈচিত্র। খেজুরের রস ও পাটালি গুড় শীতকালীন রসনা তৃপ্তির ব্যাপারে অতুলনীয়। পাটালি গুড়ের তৈরি শীতের নানারকম পিঠাপুলি বা মিষ্টান্ন দিয়ে অতিথি আপ্যায়ণ গ্রামবাংলার মানুষের দীর্ঘকালের ঐতিহ্য। মেয়েজামাই বাড়ি বা কাউকে খুশি করতে এই পাটালি আর পিঠার জুড়ি নেই।
প্রকৃতির অপার দান এই খেজুরের রস। শক্ত গাছের বুক চিরে সুস্বাদু মিষ্টি রস বের করে আনা পলস্ন্লী এলাকার মানুষের দীর্ঘকালের ঐতিহ্য। খেজুর গাছ কেটে যারা রস বের করেন তাদের বলা হয় গাছি। কার্তিক মাস এলেই তারা গাছ কাটার শুরু করেন। তাদের কাছে থাকে দুটি লম্বা দা, এর মধ্যে একটি দীর্ঘ ও ধারালো। একে বলে গাছি দা অপরটি অপেক্ষাকৃত ছোট। গাছ কাটার সময় গাছি ওই দা সাধারণত বাঁশের তৈরি একটি ঝাঁপিতে রাখেন। ঝাঁপিটি শক্ত করে বাঁধা থাকে কোমরের সাথে। এছাড়া গাছির প্রয়োজন হয় শক্ত ও মোটা একটি দড়ি আর কোমর বরাবর বাঁধার জন্য এক খণ্ড চামড়া। অনেকে চামড়ার বদলে চট বা বস্তôাও ব্যবহার করেন। শরীরের পুরো ভর ওই দড়ির মাধ্যমে চামড়ার ওপর পড়ে। খেজুর গাছ কাটা হয় এক বিশেষ প্রক্রিয়ায়। গাছি দা দিয়ে খেজুর গাছের মাথার এক দিকে পাতাসহ ডগা কেটে বুক চেঁছে সেখানে গাছ কেটে বাঁশের কঞ্চির নলি বসানো হয়। তারপর বাঁধা হয় মাটির হাড়ি বা ভাঁড়। মাটির ভাঁড়ে ওই নলি দিয়ে টপটপ করে রাতভর রস জমা হয়। খেজুর গাছ কাটা থেকে শুরু করে পাটালি (গুড়) প্রস্তুত পর্যন্তô পুরো প্রক্রিয়াটিতেই দক্ষ গাছি আর গুড় প্রস্তুতকারীর ভূমিকাই মুখ্য। কার্তিক মাসে ওই গাছ তোলা হয়। রস পাওয়া যায় তখন থেকেই। এরপর অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্‌গুন। কোন কোন গাছে চৈত্রমাস পর্যন্তô রস মেলে। প্রকৃতপক্ষে রস মৌসুম হল অগ্রহায়ণ থেকে মাঘ। তবে শীত যত বেশি পড়ে রস তত বেশি বাড়ে।
সাধারণত গাছ কাটার পর তিন দিন রস পাওয়া যায়। প্রথম দিনের রসের নাম জিবানকাটা। এই রস খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি গুড় তৈরির জন্য উৎকৃষ্ট। দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনের রসকে দো-কাটা বা তে-কাটা বলা হয়। সাধারণত তিনদিন গাছ কাটার পর মাঝখানে তিনদিন বাদ দিয়ে আবার গাছ কাটা হয়। ভাঁড়ের রস সংগ্রহের পর মাটির জালায় রস জ্বাল দিতে হয়। বাড়ির গৃহিণী, অপেক্ষাকৃত বয়স্করা রস জ্বাল দিয়ে গুড় বা পাটালি তৈরির কাজটি করে থাকেন। আশঙ্খার কথা হচ্ছে, দিন দিন খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ইট ভাটায় পুড়ছে খেজুর গাছ। বাগান কেটে জমি আবাদি করাসহ ঘরবাড়ি তৈরির কারণেও গাছের সংখ্যা কমছে দিন দিন।
পরিকল্পিতভাবে খেজুর গাছ লাগানোর কোন উদ্যোগ নেই। অর্থনৈতিকভাবে চাষিদের কাছে এটা তুলে ধরার সরকারি উদ্যোগও নেই। তবে আশার কথা, দেশের সর্বত্র খেজুর গাছের সংখ্যা কমলেও গাছির ব্য-তা কমেনি একটুও। আগে একজন গাছিকে যেখানে একটি এলাকা নিয়ে ব্যস্তô থাকতে হত, এখন তাদের কয়েকটি পাড়া কিংবা গ্রামে কাজ করতে হয়। যারা এখনও এ পেশায় আছেন তাদের অনেকেই বললেন প্রতিযোগীর সংখ্যা কম থাকায় আগের চেয়ে মন্দ নেই তারা। এছাড়া তারা যে পরিমাণে রস পাচ্ছেন তার সঠিক মুল্য পাওয়ায় তাদের ঠিকই পুষিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ১ ভাঁড় রস শহরাঞ্চলে আনা গেলে তা বিক্রি হচ্ছে ১শ টাকা পর্যন্তô। তবে যশোর, ফরিদপুর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়াতে এর মূল্য ৪০ থেকে ৫০ টাকা মাত্র।

- ইজাজ আহ্‌মেদ মিলন

কীটনাশক ছাড়া শীতের সবজি

কীটনাশক ছাড়া শীতের সবজি



শাকসবজির পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন করার জন্য রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগ করা হয়। কীটনাশক মানবদেহে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিষাক্ততা সৃষ্টি করে। কীটনাশক প্রয়োগের ২১ দিনের মধ্যে জমি থেকে শাকসবজি সংগ্রহ করলে তা বিষ সমতুল্য। কীটনাশক ছাড়া পোকামাকড় ও রোগদমন করে বিষমুক্ত শাক- সবজি উৎপাদনের কিছু পদ্ধতি এখানে উল্লেখ করা হলঃ
ফুলকপি, বাঁধাকপি, মূলা, ওলকপি, শালগম, গাজর ও ব্রুকলিঃ পোকা, প্রজাপতি এসব সবজির পাতা ও ডগা খায়। ফলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। ফুলকপি ও বাঁধাকপির মাথা ছোট হয় বা বাধে না।

দমনঃ বন গাজর, সরিষা, শালগম এসব উদি্‌ভদ এই সবজি ক্ষেতে রাখা যাবে না। হাতজাল দিয়ে ধরা যায়। আঠা লাগিয়ে আটকানো যায়। বাঁধাকপিতে কালোপচন রোগ হয়।

রোগের লক্ষণঃ চারাগাছের বীজপাত্রের কিনার কালচে দাগ হয়। পাতায় দাগ পড়ে। বীজ ১০ মিনিট গরম পানিতে ডুবিয়ে বপন করলে এ রোগ হয় না। এছাড়াও বোর্দমিকচার দেয়া যেতে পারে। বিকৃতমূল রোগ বাঁধাকপিতে হলে মূল স্ফীত হয়ে বিভিন্ন আকারের হয়। এ রোগ দমনের জন্য মাটি শোধন করে নিরোগ বীজতলায় চারা উৎপাদন করতে হবে। উক্ত সবগুলো সবজিতে হলদে হওয়া রোগ হয়। আক্রা- গাছের পাতার নিম্নাংশ বৃ- বরাবর খানিকটা অংশ প্রথম ঢলে পরে এবং পরে মরে যায়।
দমনঃ বীজ শোধন, শস্য পর্যায় অবলম্বন ফানজিসাইড প্রয়োগ এবং রোগক্রা- অংশ কেটে অন্যত্র ফেলে দিতে হবে। পাতায় দাগ রোগ হলে এসব সবজি পাতায় গোলাকার হলুদ দাগ পরে। রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য বীজ গরম পানিতে ডুবিয়ে রেখে পরে বপন করতে হবে। ডাউনি মিলডিও রোগে উক্ত সবজিগুলোর পাতা সাদা পাউডারের মত আবরণ পড়ে। রোগ দমনের জন্য বীজ গরম পানিতে ডুবানো, শস্য-পর্যায় অবলম্বন, পরিস্কার বীজতলায় চারা উৎপাদন ও সরিষা জাতীয় আগাছা দমন করতে হবে।
সিম, বরবটি, ফরাসি সিম, মটারগুটিঃ পোকামাকড়ঃ জাবপোকাঃ ফলের কচি অংশের রস চুষে খায়। এতে ফলন খুব কম হয়। ঝাঁক ধরে গাছের কচি ডগায় বসে রস খায়।
দমনঃ লেডিবার্ড বিটল, টাইগার বিটল নামক শিকারী পোকা গাছে রাখা। এরা জাবপোকা এর লার্ভা খায়। ছাই ছিঁটিয়ে, পানি স্প্রে করে এ পোকা দমন করা যায়।
ফল ছেদক পোকাঃ সিমের কুঁড়ি ,ফুল ও ফল খেয়ে ছিদ্র করে ভেতরে ঢুকে। ভেতরে ঢুকেও ফল খায় ও মলত্যাগ করে। দমনঃ আক্রা- সিম তুলে মাটিতে পুঁতে ফেলা। শুককীট পরজীবী দ্বারা আক্রা- হয়।
রেড মাইটঃ গাছের পাতা ও ফুলের কুঁড়ি থেকে রস চুষে খায়।
দমনঃ গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলা। সঠিক দূরত্বে গাছ রোপণ করা।
অ্যানথাকনোজঃ সিমে বাদামি-কালো আঁকাবাঁকা দাগ পড়ে।
দমনঃ ফসল উঠানোর পর পরিত্যক্ত কাণ্ড -পাতা পুড়িয়ে ফেলা। নিরোগ বীজ বপন করা। ক্ষেত পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে।
মরিচা রোগঃ গাছের কাণ্ডে, পাতায়, ফলে সাদা-হলুদ বর্ণের দাগ পড়ে ও পাতা শুকিয়ে যায়।
দমনঃ রোগ প্রতিরোধী জাত- ফ্লোরি, গ্রীন, ক্যানফ্রিজার, সেমিনোল জাতের শিম চাষ করা। সুস্থ, নিরোগ বীজ বপন করা। আক্রা- অংশ ছিঁড়ে পুড়িয়ে ফেলা।
টমেটো ও বেগুনঃ ফল ছেদক পোকাঃ বেগুন ও টমেটো কচি অবস্থায় ছিদ্র করে রস খায়। ফলে টমেটো নষ্ট হয় বা পচে যায়। এর লার্ভা কচি ডগাও খায়। ফলে গাছের বৃদ্ধি ব্যাহত হয়।
দমনঃ আক্রা- ডগা ও ফল ছিঁড়ে কীড়া মারতে হবে। ক্ষেত সবসময় পরিস্কার রাখতে হবে। ছাই ছিঁটিয়ে, আলোর ফাঁদ দিয়ে ও হাতজাল দিয়ে মাছি আটকানো যায়। কাজলা ও ঝুমকা জাতের বেগুনে এ পোকা আক্রমণ করে না বলে এগুলো চাষ করা উচিত।
নেতিয়ে পড়া রোগঃ চারা অবস্থায় ছত্রাক দ্বারা আক্রা- হয়ে গাছ নেতিয়ে পড়ে। বীজ বপনের পরেই বীজ ছত্রাক দ্বারা আক্রা- হলে চারা হয় না।
দমনঃ হালকা ঝুরঝুরে মাটিতে বীজ বপন করা, সেচ না দেয়া, মাটি সবসময় শুকনো রাখা। বীজ ও মাটি শোধন করে বীজ বপন করা।
লেইট ব্লাইট রোগঃ পাতা, কাণ্ড ও ফলে সাদা সাদা দাগ পরে।
দমনঃ আলু ও টমেটো পাশাপাশি জমিতে চাষ না করা। আক্রা- অংশ ছিড়ে পুড়িয়ে ফেলা।
আরলি ব্লাইট রোগঃ চারা গাছের কাণ্ড এবং বড় গাছের পাতায় বাদামি দাগ পড়ে।
দমনঃ আগাছা দমন, সুষম সার ব্যবহার ও প্রয়োজন মত সেচ দিতে হবে। বীজ শোধন করে বপন করা।
ফিউজেরিয়াম উইন্টঃ টমেটোর চারা গাছের বয়স্ক পাতাগুলো নিচের দিকে বেঁকে ঢলে পড়ে এবং মারা যায়।
দমনঃ মাটি শোধন ও বীজ শোধন করে বীজ বপন করতে হবে। রতন, অপূর্ব ও লালিমা জাতের টমেটোতে ঢলে পড়া রোগ হয় না।
অ্যানথ্রাকনোজ রোগঃ টমেটো ও বেগুনে কালো দাগ পড়ে। দাগগুলোতে পরে পচন ধরে ফল পড়ে যায়।
দমনঃ যে সব জমির ফসলে এই রোগ হয় সেখানে ৩ থেকে ৪ বছর পর পর টমেটো চাষ করা উচিত।
মোজাইক রোগঃ টমেটোর পাতায় সবুজ হলদে দাগ পড়ে। এতে ফলন কম হয়।
দমনঃ আক্রা- গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলতে হবে। জমিতে কাজ করার সময় বিড়ি সিগারেট খাওয়া উচিত না। ক্ষেত পরিস্কার রাখতে হবে। জাবপোকা ছাই দিয়ে দমন করতে হবে।
মড়ক রোগঃ বেগুন গাছের কাণ্ডে ক্যাঙ্কার হয়। বাকল খসে পড়ে, বাতাসে ভেঙে পড়ে। বেগুন শুকিয়ে যায়। পাতায় দাগ পড়ে। গাছ মারা যায়।
দমনঃ নীরোগ বীজ বপন করা। বীজ শোধন করা। কালো ও কুচকানো বীজ বপন করা উচিত না।
পাতা ছোট হওয়া রোগঃ ভাইরাসের আক্রমণে পাতা ছোট হয়। গাছ বড় হয় না। পাতা হলুদ ও সাদা হয়। পাতায় কাটা থাকে না।
দমনঃ ধুতরা জাতীয় গাছ ধবংস করা। আক্রা- গাছ তুলে পুড়িয়ে ফেলা।
উক্ত পদ্ধতিতে রোগবালাই দমন ছাড়াও সকল শাকসবজির জন্য কিছু সাধারণ পদ্ধতি আছে।
যেমন-
১· লেডিবার্ড বিটল, মেরিডবাগ, মাকড়সা, বোলতা, টাইগার বিটল, ব্রাকনিড ইত্যাদি পোকা ক্ষেতে পালন করলে এরা ক্ষতিকর পোকা ধ্বংস করে।
২· জমির ভেতরে ও বাইরে আগাছা পরিস্কার করলে ক্ষতিকর পোকা আশ্রয় না পেয়ে অন্যত্র চলে যায়।
৩· সবজি সারিতে ও সঠিক দূরত্বে রোপণ করলে বাদামি গাছ ফড়িং আক্রমণ কম করে।
৪· মৌসুমের শুরুতে শাকসবজির বীজ বপন করলে রোগবালাই কম হয়।
৫· গভীরভাবে জমি চাষ করে রোদে শুকালে পোকা ও রোগ কম হয়।
৬· পর্যায়ক্রমে ফসল চাষ করলে পোকা ও রোগ কম হয়।
৭· আলোর ফাঁদ পেতে, জমিতে ডাল/কঞ্চি পুঁতে, হাত জাল দিয়ে, গর্তে পানি বা ধোঁয়া দিয়ে পোকা দমন করা যায়।
৮· সেক্স ফেরোমেন ফাঁদঃ প্রজননের সময় হলে স্ত্রী পোকার দেহ থেকে ফেরোমেন নামক রাসায়নিক পদার্থের গন্ধ বের হয়। এই গন্ধে পুরুষ পোকা আকৃষ্ট হয়ে স্ত্রী পোকার সাথে প্রজননে অংশ নেয়। বিজ্ঞানীরা এই তত্ত্বের ভিত্তিতে ফেরোমেন রাসায়নিক পদার্থ তৈরি করে কৌটায় ভর্তি করে সবজি ক্ষেতে রাখে। ফেরোমেনের গন্ধে পুরুষ পোকা কৌটার চারপাশে ঘুরে ডিটারজেন্ট পানির মধ্যে পড়ে মারা যায়।
৯· নিম, নিশিন্দা, বিষকাঁটালী, তামাক ইত্যাদি ভেষজ কীটনাশকের মাধ্যমে পোকামাকড় দমন করা যায়।
সুতরাং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক কীটনাশক প্রয়োগ না করে উক্ত অরাসায়নিক পদ্ধতিতে পোকামাকড় ও রোগবালাই দমন করে বিষমুক্ত শাকসবজি উৎপাদন করা যায়।


- কৃষিবিদ ফরহাদ আহাম্মেদ, টাঙ্গাইল

জীব-প্রযুক্তিঃ এক ‘অদৃশ্য’ বিপ্লবের নাম


জীব-প্রযুক্তিঃ এক ‘অদৃশ্য’ বিপ্লবের নাম


প্রত্যেকটি সাধারণ কাজের পেছনে থাকে অসাধারণ কোন কিছু। ভাবতেই অবাক লাগে, ভিটামিন এখন একটি সাধারণ পিলের ভেতর চলে এসেছে। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে যখন পেঁপে ফসলে মারাত্মক ধ্বস নামলো ভাইরাল ডিজিস্‌ এর কারণে, তখন তার সাথে লড়তে হাজির হয়েছিল জীব-প্রযুক্তি। আমরা কি জানি যে বায়োটেক এনজাইম জিন্স প্যান্টের স্টোন-ওয়াশ লুক বা এ্যাপিয়্যারেন্স তৈরিতে সক্ষম? আরও মজার তথ্য হল, বায়োটেক ডিটারজেন্ট পাউডার ওয়াশিং মেশিনে মাত্র ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে কাপড় ধুতে পারছে। এর মাধ্যমে এনার্জি রক্ষা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। বিভিন্ন ধরণের গাছপালাকে পরিণত করা যাচ্ছে বায়োপ্লাষ্টিক-এ। একটি গাড়ি পুরো শতভাগ ইথানলের ওপর চলতে পারে। এই জৈব-জ্বালানি এমনকি চিনি থেকেও তৈরি হতে পারে। টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত রঙ-বেরঙের ফুল শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। আমরা কি জানি আমরা যে টাকাটি ব্যবহার করি তা অংশত তুলার মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে? বিশ্বের কোথাও না কোথাও বায়োটেক গল্পের চল রয়েছে। রয়েছে এর সাথে মানুষের সম্পৃক্ততা। খোদ ইউরোপেই ২০০০ এর বেশি সংখ্যক কোম্পানি রয়েছে যারা জীব-প্রযুক্তি উদ্‌ভাবিত পণ্যের সাথে কাজ করছে। আসছে নতুন নতুন সব সমাধানের দিক-নির্দেশনা। পরিবেশগত দিক থেকেও জীব-প্রযুক্তি যথেষ্ট নিরাপদ। জীব-প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে মানুষের জীবন-জীবিকায় আমূল পরিবর্তন আনতে হচ্ছে না। শুধুমাত্র খাপ খাওয়ানোর বিষয়টির দিকেই খেয়াল রাখতে হচ্ছে। এই অদৃশ্য বিপ্লবই সব মানুষের পাশে সহায়তার হাত বাড়িয়েছে। আজ তাই জীব-প্রযুক্তি সত্যি সময়োপযোগী এক উদ্‌ভাবনের নাম!

সংক্ষেপে কিছু পয়েন্টঃ
১· জীববিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই যে প্রযুক্তি তার নাম ‘জীব-প্রযুক্তি’। বিশেষ করে যখন এই প্রযুক্তি প্রয়োগ হয় কৃষি, খাদ্য, বিজ্ঞান এবং ওষুধের ওপর।

২· বায়ো-টেকনোলজিকে প্রায়ই তুলনা করা হয় জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সাথে।

৩· ১৯৭১ সালের পূর্বে জীব-প্রযুক্তি টার্মটি মূলত ব্যবহারই হত বিশেষত কৃষি-শিল্পের নানা পণ্যের খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের সাথে। এছাড়াও বায়োটেকনোলজির সাথে অন্যান্য ধারার রয়েছে সমন্বয়, যেমন- জেনেটিকস, মলিকিউলার বায়োলজি, বায়োকেমেষ্ট্রি, এমব্রাইওলজি এবং সেল বায়োলজি। এই ধারাগুলোর আবার সংযোগ রয়েছে অন্য সরাসরি কিছু ধারার সাথে; যেমন- কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ইনফরমেশন টেকনোলজি এবং রোবোটিকস এর সাথে।

৪· আধুনিক জীব-প্রযুক্তির শুরুটা বলা যেতে পারে ১৯৮০ সালের ১৬ জুন থেকে যদিও বলা হয় নিওলিথিক যুগ থেকেই জীব-প্রযুক্তির প্রচলন ছিল। আনন্দ চক্রবর্তী উদ্‌ভাবন করেন একটি বিশেষ ধরণের ব্যাকটেরিয়াম যা অশোধিত তেল ভাঙতে সক্ষম।

৫· ২০০৮ সালে বায়োটেকনোলজির মাধ্যমে অর্জিত রাজস্ব সারা বিশ্বে বেড়েছে ১২·৯%। এর পেছনে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে মেডিক্যাল এবং ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের উত্তরোত্তর চাহিদা বৃদ্ধি।

৬· জৈব-জ্বালানির চাহিদা বৃদ্ধি জীব-প্রযুক্তি সেক্টরের জন্য একটি দারুণ সুখবর। ইথানল ব্যবহারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে পেট্রোলিয়াম থেকে প্রাপ্ত জ্বালানির ব্যবহার ৩০% কমে যাবে ২০৩০ সালের মধ্যে।

৭· এছাড়াও উল্লেখ করতেই হচ্ছে জেনেটিক্যালি মোডিফাইড ক্রপস্‌ এর কথা। যেগুলো বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রেও উৎপাদনশীল এবং বিরূপ পরিবেশ সহনশীল। ভুট্টা এবং সয়াবিনের কথা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই দুটি শস্যের অবদান একটি বিরাট অংশে ভূমিকা রাখছে জৈব-জ্বালানি উৎপাদনে- এ কথা এখন শিরোধার্য।

৮· ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিস ফর দি এ্যাকুজিশন অফ এ্যাগ্রি-বায়োটেক ক্রপস এর একটি রিপোর্ট বলছে যে, গত এক যুগে বায়োটেক ফসল উৎপাদন বেড়েছে। বেড়েছে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। অতি-দরিদ্র এবং লড়াকু কৃষক তাদের উপার্জন বাড়িয়েছে অনেক কম খরচে।

রিপোর্টটি ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ তারিখে আইএসএএএ প্রকাশ করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ যা এই রিপোর্টটির সার-সংক্ষেপ, তা হল কম খরচে বেশি ফসল উৎপাদন। যা দারিদ্র্য নিরসনে সহায়ক হবে। উপার্জন বাড়বে কৃষকের।

৯· জীব-প্রযুক্তির ব্যবহার মূলত চারটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্যঃ (ক) স্বাস্থ্য সেবা (মেডিক্যাল), (খ) ফসল উৎপাদন ও কৃষি, (গ) ফসলের শিল্পভিত্তিক ব্যবহার (ভেজেটেবল অয়েল এবং জৈব-জ্বালানি) এবং আর একটি ক্ষেত্র হল (ঘ) পরিবেশভিত্তিক ব্যবহার।

১০· মেডিসিন-এর ক্ষেত্রে আধুনিক জীব-প্রযুক্তির ব্যবহার যেসব জায়গায় হয়ে থাকে তা হলঃ (ক) ড্রাগ উৎপাদন, (খ) ফার্মাকোজেনোমিকস, (গ) জিন থেরাপি এবং (ঘ) জেনেটিক টেষ্টিং। (১০) এছাড়াও, চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন থেরাপির ক্ষেত্রে জীব-প্রযুক্তি রাখতে পেরেছে অনবদ্য ভূমিকা। এর ভেতর হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, ক্যান্সার, আর্থরাইটিস, হেমোফিলিয়া, বোন-ফ্র্যাকচার, নানাবিধ স্ক্লেরোসিস এবং কার্ডিওভাসক্যুলার অনিয়ম নিরসনে জীব-প্রযুক্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য।


বিশ্বের সর্ববৃহৎ বায়োটেক বিস্ফোরণটি ঘটেছিল ২০০০ সালের জুন মাসে- যে দিন বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁরা প্রায় শেষ করে ফেলেছেন মানব জিনোম সিকোয়েন্সিং এর কাজ। অর্থাৎ, সৃষ্টির অজানা রহস্য জানতে শুরু করেছে মানুষ। অনেকেই বিজ্ঞানীদের এই সাফল্যকে মানুষের চাঁদের পর্দাপনের চেয়েও বড় ঘটনা বলে অভিহিত করেছেন। কারণ এই জিনোম শুধু বর্তমানকেই নয়, প্রভাবিত করবে মানবজাতির ভবিষ্যতকেও।


তৌফিক আহমেদ

অপ্রচলিত ফসল চিনা চাষ


অপ্রচলিত ফসল চিনা চাষ








অপ্রচলিত ফসল চিনা সম্পর্কে আমরা অনেকেই অবগত নই। এমন কি যারা কৃষি কাজের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত তাদের অনেকেও চিনা নামের ফসলটিকে তেমন একটা চিনেন না। বাংলাদেশের এই অপ্রচলিত ফসলটি অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে খুবই সম্ভাবনাময়। স্বল্প পরিশ্রম ও যে কোন ধরণের মাটিতে চিনা চাষ করা যায়। বিশেষ করে চরাঞ্চল এবং অন্যান্য অনুর্বর জমিতে সহজেই চিনা চাষ করা যেতে পারে।

বেলে দো-আঁশ জমি যেখানে পানি জমে না এমন জমিই চিন চাষের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। বাংলাদেশের বিভিন্ন নদীতে জেগে উঠা চরাঞ্চলে চিনা খুব ভাল জন্মে। পরিকল্পিতভাবে চিনা চাষের উদ্যোগ নেয়া হলে এই ফসলটি আমাদের কৃষি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে বলে কৃষি বিশেষজ্ঞগণ মনে করছেন। আমাদের দেশে কাউন জাতীয় যে কটি ফসল আছে তার মধ্যে চিনা অন্যতম। চিনা মৌসুমী ফসল। সাধারণত নভেম্বর হতে জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় পর্য- চিনা চাষ করা যায়। অন্যান্য ফসলের মত চিনা ছিটিয়ে বোনা যায়। আবার সারি পদ্ধতিতেও চিনা চাষ করা যায়। তবে ছিঁটানো পদ্ধতির চেয়ে সারি আকারে চিনা চাষ করাই উত্তম। এতে ফসল ভাল হবার সম্ভবনা থাকে। প্রতি হেক্টরে ১৮ হতে ২০ কেজি বীজ বপন করতে হয়। সার ব্যবহার না করেও চিনা চাষ করা যায়।

তবে ভাল ফলন পেতে হলে পরিমিত পরিমাণে সার ও পানি সেচ দিতে হবে। উন্নতজাতের বীজ বপন করলে ভাল ফলন আশা করা যায়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বেশ কটি ভাল জাতের চিনা উদ্‌ভাবন করেছে। এর মধ্যে তুষার জাত অন্যতম। এটি ১৯৭২ সালে ফ্রান্স থেকে বাংলাদেশে আনা হয়। পরবর্তীতে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ১৯৮৯ সালে তা বাংলাদেশে চাষের জন্য অনুমোদন করা হয়। দেশে যে সব জাতের চিনা আবাদ হয় ‘তুষার’ তার চেয়ে যে কোন বিচারেই উল্লেখের দাবি রাখে। এটি উচ্চ ফলনশীল, রোগ প্রতিরোধক এবং দ্রুত বর্ধনশীল। স্থানীয় যে কোন জাতের চেয়ে ‘তুষার’ জাতের চিনার ফলন ৩৫ হতে ৪০ শতাংশ বেশি হয়। প্রায় ১০ হতে ১৫ দিন আগে ফসল তোলা যায়। প্রতি হেক্টর আড়াই হতে ৩ টন ফলন পাওয়া যেতে পারে। চিনা পাকার সাথে সাথেই ক্ষেত থেকে তুলে আনতে হয়। কারণ এই ফসলটি সামান্যতেই মাটিতে পড়ে যায়। আমাদের দেশে যেহেতু চিনা অপ্রচলিত একটি ফসল তাই এর ব্যবহার সম্পর্কেও আমরা তেমন একটা সচেতন নই।

চিনা দিয়ে পায়েস রান্না করা যায়। এ ছাড়া নাড়-, মোয়া, খিচুরি ও নানা ধরনের পিঠা ও নানা ধরণের খাবার তৈরি করা যায়। কবছর আগের এক পরিসংখ্যান হতে জানা গেছে, বাংলাদেশে মোট ১৭ হাজার হেক্টর জমিতে চিনা চাষ করা হয়। এত ফলন পাওয়া যায় ১৩ হাজার টন। উদ্যোগ নিলেই চিনা চাষের পরিমাণ ও উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাড়ানো যেতে পারে।

- এম· এ· খালেক, ঢাকা

দেশি মাছ রক্ষার উপায়-১


দেশি মাছ রক্ষার উপায়-১






আমাদের দেশে আগে হাওড়-বাওড়-বিলে এক সময় প্রচুর পরিমাণে দেশিয় প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। এসব প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট হাওড়-বাওড়গুলোর কিছু কিছু জায়গায় সারা বছরই পানি থাকতো। এতে বছর শেষে প্রচুর পরিমাণে দেশিয় প্রজাতির মাছ থেকে যেত যা থেকে পরবর্তী বছরে দেশিয় প্রজাতির মাছের জন্ম হত। কিন্তু দিনে দিনে প্রাকৃতিকভাবে এসব হাওড়-বাওড়গুলোর তলা ভরাট হয়ে যাওয়াতে এসব আশ্রমগুলো সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। আগে যেখানে সারাবছর পানি থাকতো সেখানে আজ ভরা মৌসুমেও পানি থাকে না। যার কারণে এসব শুকিয়ে যাওয়া হাওড়-বাওড়গুলোতে এখন ধান আবাদ হচ্ছে। এর পরে অনেক জলাভূমিতে পানি থাকলেও সেখানে মাছের অি-ত্ব থাকা পর্য- সেচ দিয়ে এসব মাছগুলোকে মেরে সাফ করে দেয়া হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে পরের বছর মাছের প্রজন্মের জন্য অবশিষ্ট আর কিছুই থাকছে না।


এভাবে দেশিয় প্রজাতির মাছ এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। ইতিমধ্যে অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। চৈত্র-বৈশাখের খরার পর আষাঢ়ে বৃষ্টির পানি পেলেও মাছের দেখা মেলে না আজকাল। ছোটবেলায় দেখেছি আষাঢ়ের বৃষ্টির পর ডোবা, খাল, বিল ছোট ছোট মাছে- যেমন মলা, দারকিনা, কয়েক প্রজাতির পুটি মাছ, টেংরা, গুলশা, খলিশা, চান্দা ইত্যাদি নানান প্রজাতির মাছে ভরে যেত। কিন্তু এখন আষাঢ়ে বৃষ্টি হলে খালে-বিলে পানি হলেও এসব মাছ আগের মত দেখা যায় না। নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে আমি দেখেছি, খালে-বিলের এসব ছোট ছোট মাছ প্রতিমাসেই একবার করে বাচ্চা দেয়। যার ফলে ভরা বর্ষা মৌসুমে এসে খাল-বিল মাছে ভরে যেত। কিন্তু বর্তমানে মাছে আর আগের মত ডিম দিতে পারে না। এর কারণ, কয়েক মাস পানি থাকলে ছোট মাছের বংশ বৃদ্ধি ঘটে না।

আগের ইংরেজ শাসকদের শাসন আমলকে যে জোঁকের সাথে তুলনা করা হত সেই জোঁকও এখন আর খালে-বিলে পাওয়া যায় না। অথচ আমরা ছোটবেলায় দেখেছি জোঁকের জন্য খালে-বিলে নামা যেত না। পানিতে নামলেই বিভিন্ন প্রজাতির জোঁক আসতো ধরতে। এখন বৈশাখ-জৈষ্ঠ্যেও সেই জোঁকের দেখা মেলে না। আগে শামুকের দেখাও মিলতো প্রচুর। খাল-বিলের পাড়ে প্রচুর পরিমাণে সাদা শামুকের ডিমের ছোট ছোট -ূপ দেখা যেত। বিভিন্ন মৎস্য খামারের খাদ্য হিসেবে শামুক ব্যবহার হওয়াতে এখন শামুকের সংখ্যাও কমে গেছে। এর জন্য দায়ী আমরাই।


নানা কারণের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার ব্যবহার করছি আমরা। এ ছাড়াও অবাধে কীটনাশক ব্যবহার করছি। কীটনাশক ব্যবহারের ফলে এসব মাছ, শামুক বা প্রাণীর প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে বর্ষা মৌসুমেও মাছের বংশবৃদ্ধি হচ্ছে না। কয়েক মাস ধরে খাল-বিল থেকে দূষিত পানি বেরিয়ে যাবার পর মাছের প্রজনন উপযোগী হতে হতে ততদিনে মাছের প্রজনন মৌসুম শেষ হয়ে যায়। এর পরেও একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণের ছোটমাছ বংশ বৃদ্ধি করে। এভাবেই আমাদের দেশের ছোট মাছের বংশ বৃদ্ধির হার একেবারে কমে গেছে। হারিয়ে গেছে বা বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক প্রজাতির মাছ। সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে একটি অতীত ঐতিহ্যে।
আমরা প্রচুর টাকা খরচ করে নানা জায়গায় সেমিনার করছি। কিন্তু বা-বে কাজ করছি কম। ঐতিহ্যকে ধরে রাখার পক্ষে কোন কাজই করে যাচ্ছি না। আমরা সবাই মিলে সচেতন হলে কিছুটা হলেও এসব ছোটমাছ রক্ষা করতে পারবো। প্রাকৃতিক জলাশয় বিভিন্ন কারণে সংকুচিত হচ্ছে এটাকে মেনে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। কেননা, আমাদের খাদ্য চাহিদার বিপরীতে ধানের আবাদ যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে এর সাথে সংশ্লিষ্ট কীটনাশকের ব্যবহার।

আমাদের সবদিকেই খেয়াল রাখতে হবে। ধানের উৎপাদনের কথা মাথায় রাখতে হবে। আবার মাছের বংশ বৃদ্ধির কথাও চিন্তা করতে হবে। কেননা, প্রকৃতি যেভাবে যাচ্ছে আমাদেরও সেভাবে যেতে হবে। কারণ, প্রকৃতিকে ধরে রাখার সামর্থ আমাদের নেই। তবু বিভিন্নভাবে এর লাগাম টেনে এর গতি মন্থর করতে হবে। প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়েই প্রকৃতিকে জয় করতে হবে। আর তাই বৈশাখ-জৈষ্ঠ্যেও বৃষ্টির কিছুদিন পর পানিতে বিষক্রিয়া কিছুটা কমে গেলে যখন মাছ প্রাকৃতিক জলাশয়ে ডিম পাড়া বা বাচ্চা দেয়া শুরু করবে তখনই কারেন্টজালের ব্যবহার কঠোর হাতে দমন করতে হবে। প্রথমত, যদিও সরকারিভাবে কারেন্টজাল ব্যবহার নিষিদ্ধ, কিন্তু এর কোন প্রয়োগ বা-বে লক্ষ্য করা যায় না। আমি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি যে, জৈষ্ঠ্যে যে মাছগুলো ডিম পাড়ে সেই বাচ্চাগুলোই পরবর্তীতে ২/৩ মাস পর থেকে আবার প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে আবার বাচ্চা দিয়ে থাকে। বিশেষ করে দারকিনা, পুটি, ছোট খলিশা, কৈ, খলিশা, টাকি, শিং ইত্যাদি। আর তাই এদের প্রজননের ওপর বিশেষভাবে সচেতন হলে এখনও আশ্বিন-কার্তিকে এসে প্রচুর পরিমাণে ছোটমাছ পাওয়া সম্ভব। কিন্তু বা-বে যা ঘটে তা হল যখন বৈশাখে প্রথম বাচ্চা হয় সেই বাচ্চাগুলো প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগেই কারেন্টজাল দিয়ে সমূলে বিনাশ করা হয়। গ্রামাঞ্চলে যে কি পরিমাণে কারেন্টজাল ব্যবহার করা হয় তা হয়তোবা অনেকেরই জানা নেই। খাল-বিলে অসংখ্য কারেন্টজাল অবাধে ব্যবহার করা হয় নিয়মিত প্রতিযোগিতার মত।


শুধু কারেন্টজালের ব্যবহার বন্ধ করতে পারলেই এইসব ছোট ছোট মাছের উৎপাদন জ্যামিতিকহারে বহুগুণ বেড়ে যাবে, এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। দ্বিতীয়ত, সীমিত আকারে হলেও উপজেলাভিত্তিক একটি করে মৎস্য অভয়াশ্রম গড়ে তোলা উচিত। অভয়াশ্রমগুলো এভাবে করা উচিত যেন আশ্রমের একদিক দিয়ে পানির স্রোত এসে অন্য দিক দিয়ে স্রোত বয়ে যেতে পারে। তাতে বর্ষার প্রাক-মৌসুমে প্রচুর পরিমাণে এইসব ছোট ছোট মাছ ডিম ছাড়তে পারে। যা পরবর্তীতে এই সব মৎস্য অভয়াশ্রাম হতে ছোট মাছের মাতৃমাছ বা ছোটমাছ স্থনারিত হয়ে সম- এলাকা ছড়িয়ে যাবে। যেহেতু এইসব ছোটমাছ খুবই দ্রুত এক জায়গা হতে অন্য জায়গায় স্থানা-রিত হয়ে থাকে। এ ছাড়াও কিছু কিছু ছোট মাছকে পুকুরেই বংশ বৃদ্ধি করানো যেতে পারে। এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে ধারাবাহিকভাবে লেখার আশা রাখছি। (চলবে)

- এ· কে· এম· নূরুল হক

শনিবার, ১০ জানুয়ারী, ২০০৯

আলু তোলার সময় করণীয়

আলু তোলার সময় করণীয়







ক্ষেত থেকে আলু তোলার পরপরই সব আলু বিক্রি হয় না এবং তা খাওয়া যায় না। এক মৌসুমে উৎপাদিত আলু দিয়েই আমাদের সারা বছর চলতে হয়। তাই আলু তোলার পর ভালোভাবে সংরক্ষণ করতে না পারলে তা নষ্ট হয়। তবে ঘরে বা হিমাগারে যেখানেই আলু সংরক্ষণ করা হোক না কেন, সংরক্ষণযোগ্য আলুর মান ভালো না হলে সেসব আলু বেশি দিন ভালো থাকে না এবং পরের বছর তা বীজ আলু হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। আলুর মান ভালো করার জন্য আধুনিক চাষ ব্যবস্থাপনা যেমন প্রয়োজন, তেমনি মান ভালো রাখতে প্রয়োজন আলু তোলার সময় এবং তোলার পর তার ব্যবস্থাপনা। এটুকু সঠিকভাবে করতে পারলেই আলুর মান বাড়ে, বেশি দিন সংরক্ষণ করা যায় এবং পরে দামও ভালো পাওয়া যায়। এখন আলু উঠতে শুরু করেছে। তাই তোলার সময় আলুচাষি ভাইরা নিুলিখিত কাজগুলো করে আলুর মান বাড়াতে পারেন।

আলু তোলার আগে গাছ পাতা ছাঁটাইঃ যেসব ক্ষেত থেকে বীজ হিসেবে আলু রাখা হবে সেসব ক্ষেত থেকে আলু তোলার আগেই মাটির ওপর থেকে গাছ কেটে ফেলতে হবে। সাধারণত আলু রোপণের ৮০ দিন পর এ কাজ করা হয়। তবে জাতভেদে এ সময়ের হেরফের হতে পারে। গোড়া থেকে গাছ কেটে সেসব গাছ কম্পোস্ট তৈরির কাজে ব্যবহার করা যায়। তোলার আগে গাছ কাটলে আলুর খোসা দ্রুত শক্ত হয়ে ওঠে। আলুও শক্ত হয়। সুতরাং সেগুলো একটু তাড়াতাড়ি তোলা যায়। সাধারণত গাছ কাটার দুই সপ্তাহ পর আলু তোলা হয়। তা ছাড়া এভাবে গাছ কাটার ফলে রোগাক্রান্ত গাছের কাণ্ড থেকে বিভিন্ন রোগের জীবাণু আলুতে প্রবাহিত হতে পারে না। বিশেষ গাছ না কেটে রেখে দিলে যখন কাণ্ড ঢলে শুকিয়ে যেতে শুরু করে তখন গাছে থাকা ভাইরাস জীবাণুগুলো আলুতে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এসব আলু বীজ হিসেবে রেখে পরে রোপণ করলে সেসব গাছ ভাইরাসজনিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।

একইভাবে মড়ক, কাণ্ডপচা এবং ব্যাকটেরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগও প্রতিহত করা যায়। আলু তোলার সময়ঃ জাতভেদে সাধারণত রোপণের ১০০ থেকে ১১০ দিন পর আলু তোলা হয়। সঠিক সময়ের আগে বা পরে কখনো আলু তোলা উচিত নয়। এতে বীজ আলুর মান খারাপ হয়ে যায়। পরিষ্কার দিনে বা রৌদ্রযুক্ত আবহাওয়ায় আলু তুলতে হবে। কেননা রোদ দ্রুত আলু শুকাতে ও শক্ত হতে সাহায্য করে। তোলার পর আলু থেকে আলগা মাটি অবশ্যই পরিষ্কার করতে হবে। বৃষ্টির মধ্যে আলু তুললে সেসব আলু দ্রুত পচে যেতে পারে। বৃষ্টি বা মেঘলা থাকলে কয়েক দিন অপেক্ষা করা যেতে পারে। তবে আলু তোলার উপযুক্ত সময়ের ১০ দিন পর যাওয়া ঠিক নয়। এতে আলুর মান খারাপ হয়, ওই উড়চুঙ্গা ফুটো করে, দাদ বা স্ক্যাব রোগ হয়। আলু তোলার পদ্ধতিঃ আলু তোলার সময় সতর্ক না হলে আলুর মান খারাপ হয়। দু’ভাবে আলু তোলা যায়­ হাত দিয়ে এবং নিড়ানি বা কোদাল ব্যবহার করে। হাত দিয়ে আলু তোলা কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ হলেও বীজ আলুর জন্য এ পদ্ধতি উত্তম। এতে আলুর কোনো ক্ষতি হয় না। কিন্তু নিড়ানি বা কোদাল দিয়ে আলু তুললে অনেক আলু কেটে যায় বা ক্ষত হয়। পরে সেসব ক্ষত আলুর বিভিন্ন রোগ বয়ে আনে, ক্ষত আলু সংরক্ষণ করা যায় না। কোনো কোনো জায়গায় আলুর সারির মধ্য দিয়ে হাতে লাঙল টেনে মাটি আলগা করে পরে হাত দিয়ে আলু তোলা হয়। তবে এ সময় সতর্ক থাকতে হয় যেন কোনোভাবেই আলু কাটা না পড়ে। আলু তুলে ক্ষেতের মধ্যেই মাঝেমধ্যে স্তূপ করে রোদে ফেলে রেখে দিলে শুকিয়ে যায়। তখন আলগা মাটি পরিষ্কার করতে সুবিধা হয় এবং আলুও শক্ত হওয়ার সুযোগ পায়। তোলার পর পরিচর্যাঃ তোলার পর ক্ষেতে বা গুদাম ঘরের আশপাশে খোলা জায়গায় আলু ছড়িয়ে রোদে শুকিয়ে নিতে হয়। এরপর পরিষ্কার করে বাছাই করা দরকার। ওজনভিত্তিতে বা অভিজ্ঞতার আলোকে আলুকে গ্রেডিং করতে হয়।

তবে গ্রেডিং করার আগে অবশ্যই কাটা, ক্ষত ও রোগ পোকায় আক্রান্ত আলু বেছে আলাদা করতে হবে। ওজনভিত্তিতে আলুকে চারটি গ্রেডে ভাগ করা যেতে পারে­ প্রতি কন্দের ওজন ৮০ গ্রামের ঊর্ধ্বে, ৬০-৮০ গ্রাম, ৩০-৬০ গ্রাম ও ৩০ গ্রামের নিচে। প্রতিটি আলুর ওজন ৬০ গ্রামের ঊর্ধ্বে হলে সেগুলো বীজের জন্য না রেখে বা হিমাগারে না রেখে বিক্রি করে দেয়া ভালো। বীজের জন্য ৩০-৬০ গ্রাম আকারের আলু ভালো। গ্রেডিংয়ের পর যথারীতি বস্তায় ভরে স্থানান্তর করতে হয় বা গুদামে-হিমাগারে রাখতে হয়।


মৃত্যুঞ্জয় রায়

রবিবার, ৪ জানুয়ারী, ২০০৯

বার্ড ফ্লু প্রতিরোধে দরকার সার্বিক প্রস্তুতি



বার্ড ফ্লু প্রতিরোধে দরকার সার্বিক প্রস্তুতি







আবারও দেখা দিয়েছে বার্ড ফ্লু ভাইরাস। মহামারি আকারে না ছড়ালেও কুড়িগ্রাম সীমা- এলাকার দুটি খামারে, সাভারের একটিতে, নরসিংদীতে দুটিতে বার্ড ফ্লু শনাক্ত করা হয়েছে। ২৬ ডিসেম্বর রাজারহাটের আমতলী গ্রামের এক পোল্টি ফার্মে ২৯৭টি মুরগি এবং ১২৫টি ডিম ধ্বংস করা হয়েছে। পাশাপাশি ইতিমধ্যে একদিনের বাচ্চার দাম ৩০ থেকে ৩৫ টাকা কমে এখন ৩ থেকে ৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাও অনেককে কিনছে না। সংবাদপত্রে প্রকাশিত রিপোর্টে থেকে এ তথ্য জানা যায়।

বার্ড ফ্লু কী ও কেন? বার্ড ফ্লু হচ্ছে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা। যা আপাতদৃষ্টিতে মুরগি বা যেকোন পাখির একটি মারাত্মক সংক্রামক ভাইরাসজনিত ব্যধি। ১০০ বছরেরও আগে ইতালিতে প্রথম এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস শনাক্ত হয়। একটি সময় পর্য- বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত ছিলেন, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে সাধারণত পাখি ও শুকর ছাড়া অন্যান্য প্রজাতির প্রাণী আক্রা- হয় না। তবে ১৯৯৭ সালে প্রথম হংকংয়ে মুরগি থেকে মানুষের দেহে এই ভাইরাস সংক্রমিত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। একবারে ১৮ ব্যক্তিকে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসে আক্রা- অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করা হয় এর মধ্যে ৬ জনের মৃত্যু ঘটে। বিজ্ঞানীদের গবেষণা উঠে এসেছে যে, ১৫টি এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস টাইপের মধ্যে H5N1 কয়েকটি কারণে বিশেষ উদ্বেগজনক ও মারাত্মক। এই টাইপের ভাইরাসের দ্রুত বিবর্তন ঘটে যার মধ্যে রয়েছে মানুষের মারাত্মক রোগ সৃষ্টি করার ক্ষমতা। যে সম- পাখি এই ভাইরাসে আক্রা- হওয়ার পরও বেঁচে থাকে তাদের শ্বাস ও বিষ্ঠা থেকে কমপক্ষে ১০ দিন পর্য- এই ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, কিছুদিন আগ পর্য- ইনফ্লুয়েঞ্জার চিকিৎসার জন্য চারটি ওষুধের কথা শোনা যায়। এগুলো হচ্ছে এমানটাডিন (Amantadine), রিমানটিডিন (Rimantidine), টমিফ্লু (Tamiflue) এবং রেলেঞ্জা (Relanza)। এর মধ্যে প্রথম দুটি ওষুধ H5N1 সংক্রমণের জন্য কার্যকর নয়। পরবর্তী দুটি ওষুধ এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের মারাত্মকতা হ্রাস করে। পৃথিবীর কোন কোন দেশে বার্ড ফ্লুর ভ্যাকসিন ব্যবহৃত হচ্ছে। সরকার উদ্যোগ নিলে তা আমাদের দেশে দ্রুত আমদানি করা সম্ভব।

২০০৭ সালের ২১ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম বার্ড ফ্লু শনাক্ত হবার পর গত ৩১ ডিসেম্বর ২০০৮ সাল পর্য- মাত্র ২১ মাসে এ রোগ দেশের ৪৭টি জেলার ১৪১ উপজেলায় ছড়িয়ে পড়ে। মোট ২৯০টি ফার্মে এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। বার্ড ফ্লুতে এবং বার্ড ফ্লুর বি-ার রোধে নেয়া ব্যবস্থায় এ পর্য- ৫৫০টি ফার্মে ১৬ লাখ ৪৫ হাজারেরও বেশি মুরগি মারা গেছে অথবা নিধন করা হয়েছে। নিধন করা মুরগির জন্য ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।

খোঁয়াড় ও ফার্মে পালান করা মুরগি ও হাঁস বর্তমানে ৪০ লাখ পরিবারে নিয়মিত আয়ের এক বিরাট অংশ। ১ কোটি ৬০ লাখ গ্রামীণ মহিলা দেশি জাতের মুরগি পালন করে। ১লাখ ২৪ হাজার কৃষক জড়িত-ভুট্টা, মাছ ও অন্যান্য পোল্টিফিড উৎপাদনে। ৭৮% ডিম, ৮৬% মাংস আসে খোঁয়ার (গৃহপালিত)- এর মুরগি থেকে। আমাদের দেশে সব ধরণের মাংসের মোট উৎপাদনের এক তৃতীয়াংশ আসে পোল্টিখাত থেকে। বাৎসরিক হাঁস-মুরগির মাংস উৎপাদনের পরিমাণ মাথাপিছু ২ কেজি। মাথাপিছু বাৎসরিক ডিম উৎপাদনের পরিমাণ ৩৫টি।

লক্ষণসমূহঃ বার্ড ফ্লু ভাইরাসে আক্রা- হওয়ার ৩ থেকে ১০ দিন পর রোগের লক্ষণ টের পাওয়া যায়। আক্রা- পাখির পালক উসকোখুসকো হয়ে যায়। মাথার ঝুঁটির গোড়ায় রক্তক্ষরণ হয়। ক্ষুধামন্দা ও অবসাদগ্র- হয়ে পড়ে। পায়ের পাতা ও হাফ-জয়েন্টের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে রক্ত জমে যায় ও রক্তক্ষরণ হয়। ডিম উৎপাদন কমে যায় ইত্যাদি।

বার্ড ফ্লু ভাইরাস যেভাবে ছড়ায়ঃ রুগ্ন পাখির বিষ্ঠা থেকে। রুগ্ন পাখির শ্লেষ্মা ও লালা থেকে। যারা রুগ্ন পাখি পরিচর্যা করে, তাদের দ্বারা। আক্রা- পাখির সরাসরি সংস্পর্শে এলে। পাখির চারণক্ষেত্র-হাওড়-বাওড়, দীঘি-নদী-জলাশয় ইত্যাদির পানি ব্যবহারে। রুগ্ন পাখির ব্যবহৃত নানা উপকরণ- খাঁচা, খোঁয়াড়, রিকশা- ভ্যান ডিমের টে্‌্র ইত্যাদি থেকে।

রোগ বি-ারের মাধ্যমঃ পাখি থেকে। পাখি থেকে মানুষ (খুব কম। ২০০৩ সাল থেকে এ পর্য- ৩০০-এর কম। তবে মৃত্যুহার খুবই উচ্চ (৬৪%)। মানুষ থেকে মানুষে (এটাই সবচেয়ে ভয়ের। ১৯১৮, ১৯৫৭ এবং ১৯৬৭- তে এটা হয়েছিল। জাতিসংঘের ইনফ্লুয়েঞ্জা সমন্বক ড· ডেভিড নাবারোর আশঙ্কা, ঠিক সময়ে প্রতিরোধ করা না গেলে আগামীর ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারিতে মৃত্যের সংখ্যা ৫০ লাখ থেকে ১৫ কোটি পর্য- হতে পারে)।

প্রতিরোধ ও প্রস্তুতিঃ জবাইর পরঃ জবাই করা হাঁস-মুরগি উঠানে ছুড়ে ফেলবেন না। রক্ত, পালক, নাড়ি-ভঁূড়ি, নখ, চামড়া একটি পাত্রে রাখুন। পরে এসব বর্জø ৩ ফুট গভীর গর্তে পুঁতে ফেলুন। দা-বঁটি-ছুরি ও হাত সাবান দিয়ে টিউবওয়েলের পানিতে ভাল করে ধুয়ে নেবেন। ময়লা হাত থেকে শতকরা আশিভাগ রোগে জন্ম হয়। হাত সব সময় পরিষ্কার রাখুন।

যেভাবে হাত ধুতে হবেঃ দুই হাতের কব্জি পর্য- সাবান দিয়ে, ফেনা তুলে, রগড়ে রগড়ে, অ-ত ৩০ সেকেন্ড হাতের পাঞ্জার দুই পিঠ, আঙ্গুলের ফাঁক, নখের ভেতর ভালভাবে ধুতে হবে। যে কোন ধরণের খাদ্যদ্রব্য ছোঁয়ার আগে, খাবারের আগে, টয়লেট ব্যবহারের পর, শিশুর মল-মূত্র সাফ করার পর, এ ছাড়া দিনে কয়েকবার এমনিতেই সাবান দিয়ে হাত ধোবেন।

গণসচেতনতাঃ বার্ড ফ্লু প্রতিরোধে সাধারণ মানুষকে সচেতন করে তুলতে হবে। এক্ষত্রে পোষ্টার, লিফলেট, মাইকিং, গ্রাম নাটক, গণসঙ্গীত ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে। বার্ড ফ্লু থেকে বাঁচা খুবই সহজ। তবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে কঠোরভাবে। যারা মুরগির ফার্মে কাজ করেন কিংবা যে বাড়ির মুরগির বার্ড ফ্লু হয়েছে তাদের কারও গায়ে মাথায় ব্যথা করে জ্বর আসলে তাকে দেরি না করে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। তিনি যে হাঁস-মুরগির ফার্মে কাজ করেন কিংবা রোগির বাড়িতে যে বার্ড ফ্লু হয়েছে সে কথা ডাক্তারকে জানাতে হবে।

বার্ড ফ্লু রোধে স্বাস্থ্যবিধিঃ সাবান দিয়ে হাত ধোয়া। হাঁচি-কাশি নিয়ন্ত্রণ। কফ-থুথু না ফেলা। শিশুদের হাঁস-মুরগি থেকে দূরে রাখা। খোঁয়াড় পরিষ্কার রাখা। খোঁয়াড় পরিষ্কার করার সময় কাপড়ে নাক-মুখ ঢেকে রাখা। ঘর থেকে বাইরে খোঁয়াড় সরিয়ে নেয়া। মুরগির বিষ্ঠা মুখবন্ধ গর্তে ফেলা। জবাইর পর মুরগিকে একটি প্লাস্টিকের পাত্রে রাখুন যাতে সব রক্ত ওই পাত্রে জমা থাকে। জবাই করে মুরগিকে উঠানে ছুড়ে ফেলবেন না। এতে মুরগির রক্ত থেকে রোগ ছড়াতে পারে। জবাইর পর দা-বঁটি হাত ভালভাবে সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। মুরগির পালক, চামড়া, নাড়ি-ভঁড়ি, নখ-ঠোঁট, রক্ত বাড়ির এককোণে ২ হাত গভীর গর্ত করে পুঁতে রাখুন। অথবা পুডিযে ফেলুন। যেখানে কাঁচা মাংস রাখা হয়েছিল সে স্থান সাবান দিয়ে ভাল করে ধুয়ে ফেলুন। মাংস ভাল করে কষিয়ে রান্না করুন। সাবান অথবা সোডা গোলা পানিতে ভাল করে ধুয়ে তবেই ডিম ঘরে তুলবেন। ডিম পূর্ণ সিদ্ধ অথবা পূর্ণ ভাঁজি করে খাবেন। মরা হাঁস-মুরগি পুড়িয়ে অথবা ২ হাত গর্ত করে পুঁতে ফেলুন। পলিথিন, কাগজ অথবা গাছের পাতা দিয়ে মরা পাখি গর্তে ফেলুন। সাথে সাথে ভাল করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলুন।


সাহারা তুষার