শনিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

বোরো ধানে সেচসংকট উপায় কী?

বোরো ধানে সেচসংকট উপায় কী?
দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে বোরো ধানে সেচসংকটের খবর আসছে। কোথাও কোথাও সেচের পানির জন্য সড়ক অবরোধ ও মিছিল হচ্ছে। বিদ্যুতের ঘাটতি ও জ্বালানি তেলের দাম বেশি এবং সরবরাহ কম হওয়ায় সেচসংকট হচ্ছে। এই সুযোগে সেচপাম্পের মালিকেরা সেচের উচ্চমূল্য নেওয়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে। এতে কৃষকেরা বোরো ধানে সঠিক পরিমাণে সেচ দিতে পারছে না। বোরো ধানে কুশি বৃদ্ধি পর্যায় থেকে কাইচ থোড় আসা পর্যন্ত পর্যাপ্ত পানির প্রয়োজন হয়। পানির ঘাটতি হলে ফলন কম হয় এবং ধানে চিটা হয়। এ সময় বৃষ্টি হয় না বলে পানির স্তর ভূগর্ভে চলে যায়, যা গাছ গ্রহণ করতে পারে না। সেচের পানি বাষ্পীভবন, অনুস্রবণ, চুয়ানো, শোষণ ও পরিস্রবণ প্রক্রিয়ায় অপচয় হয়। সেচের পানির এই অপচয় রোধ করে কার্যকারিতা বাড়ালে অল্প সেচ দিয়েই গাছে পানির চাহিদা পূরণ করা যায়।
এর কিছু কৌশল এখানে উল্লেখ করা হলো-
* সেচনালা সম্ভব হলে পাকা করা উচিত। অন্তত এঁটেল মাটি দিয়ে লেপে দেওয়া যেতে পারে। সেচ নালায় পলিথিন কাগজ বিছিয়ে দিলেও পানি মাটিতে অনুস্রবণ, চুয়ানো ও শোষণ বন্ধ হবে।
* পুরোনো সেচনালার ছিদ্র, ভাঙা, পাড় উঁচু যাবতীয় সংস্কার ও মেরামত করতে হবে।
* মাঠ ফসল ও উদ্যান ফসলে নানা পদ্ধতিতে সেচ দিলে পানির অপচয় কম হয়।
* পরিমাণমতো সেচ দিতে হবে। এ জন্য সেচ দেওয়ার সময় জমির অবস্থা খেয়াল রাখতে হবে।
* রাতে সেচ দেওয়া প্রয়োজন। এতে পানি বাষ্পীভূত হয়ে বাতাসে কম যাবে। অপরদিকে রাতে বিদ্যুতের ভোল্টেজ বেশি থাকে।
যতটুকু সম্ভব সেচনালার দৈর্ঘ্য কমাতে হবে। এতে মাটিতে পানি শোষণের পরিমাণ কম হয়।
* একই নলকূপের অধীনের জমিগুলো সমতল হলে সব জমিতে সমান পরিমাণ পানি সরবরাহ হবে।
* মাটিতে জৈব পদার্থ দিতে হবে। জৈব পদার্থ মাটির পানি ধারণক্ষমতা বাড়ায়। ফলে পানি মাটির বেশি নিচে যাবে না।
* সেচনালা ফসলের জমির দিকে ঢালু রাখতে হবে।
* মাটির গঠন ও মাটির কণার আকার-আকৃতির ভিত্তিতে সেচ দিতে হয়। এতে পানির পরিমাণ অনুসারে সেচ দেওয়া যায়।
* জমির আইল শক্ত করে বাঁধা উচিত। সেচ দেওয়ার সময় মাঝেমধ্যে সেচনালা পরীক্ষা করতে হবে। ছিদ্র হলে সঙ্গে সঙ্গে ছিদ্র বন্ধ করতে হবে।
* সেচের খরচ কমানোর জন্য ঢেঁকিকল দিয়ে সেচের পানি উত্তোলন করা যায়। এতে বিশেষ কিছু সুবিধা আছে। যেমন-পানি উত্তোলনের জন্য বিদ্যুৎ বা জ্বালানি খরচ হয় না। একজন মানুষ খুব সহজে পা দিয়ে পানি উঠাতে পারে। ঢেঁকিকল দামে খুব সস্তা। অনেক দিন ব্যবহার করা যায়। প্রতি মিনিটে ৭৫ লিটার পানি তোলা যায়। মেরামত খরচ নেই বললেই চলে। পরিবারের সবাই পানি উঠাতে পারে। সেচের জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করতে হয় না। এক মৌসুমেই মোট খরচের প্রায় তিন গুণ আয় করা যায়। ফসলের প্রয়োজন অনুযায়ী সেচ দেওয়া যায়।
ফরহাদ আহাম্মেদ

লাভের সবজি কচুর লতি

লাভের সবজি কচুর লতি




বাংলাদেশে কচুর মুখী ও কচুর লতি জনপ্রিয় সবজি। এ ছাড়া কচুর শাক ও কচুর ডগা পুষ্টিকর সবজি হিসেবে প্রচলিত। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের এক হিসাব মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে পানিকচুর চাষ হচ্ছে, যা থেকে প্রায় ৮০ থেকে ৯০ হাজার টন লতি পাওয়া যাচ্ছে। বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চাষ করা হলে উৎপাদনের পরিমাণ কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব। জাতঃ বাংলাদেশে লতিকচুর অনেক জাত থাকলেও বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট থেকে অবমুক্ত লতিকচুর জাত ‘লতিরাজ’ চাষ বেশ লাভজনক।

মাটিঃ জৈব পদার্থসমৃদ্ধ পলি দো-আঁশ থেকে এঁটেল দো-আঁশ। বেলেমাটিতে রস ধরে রাখা যায় না বলে চাষের জন্য এ ধরনের মাটি ভালো নয়।

জমিঃ মাঝারি নিচু থেকে উঁচু যেকোনো জমি। বৃষ্টির পানি জমে না, কিন্তু প্রয়োজনে সহজেই পানি ধরে রাখা যায়।

জমি তৈরিঃ কচুর লতি পানিকচু থেকে পাওয়া যায়। লতি উৎপাদনের জন্য পানিকচুর জমি শুকনো ও ভেজা উভয় অবস্থাতেই তৈরি করা যায়। শুকনোভাবে তৈরির জন্য চার থেকে পাঁচটি আড়াআড়ি চাষ ও মই দিয়ে মাটি ঝুরঝুরে ও সমান করতে হয়। ভেজা জমি তৈরির জন্য ধান রোপণে যেভাবে জমি কাদা করা হয় সেভাবে তৈরি করতে হয়।

রোপণ সময়ঃ খরিপ মৌসুমে কচুর লতি পাওয়া যায় বা সংগ্রহ করা যায় বলে জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি মাস রোপণের জন্য উপযুক্ত সময়।

বংশবিস্তারঃ পূর্ণবয়স্ক পানিকচুর গোড়া থেকে যেসব ছোট ছোট চারা উৎপন্ন হয় সেগুলোই বীজ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

চারা রোপণ পদ্ধতিঃ পানিকচুর চারা কম বয়সী হতে হয়। চার থেকে ছয় পাতার সতেজ চারাগুলোই রোপণের জন্য নির্বাচন করতে হয়। রোপণের সময় চারার ওপরের দুই থেকে তিনটি পাতা রেখে নিচের বাকি সব পাতা ছাঁটাই করে দিতে হয়। চারার গুঁড়ি বা গোড়া বেশি লম্বা হলে কিছুটা শিকড়সহ গুঁড়ির অংশবিশেষ ছাঁটাই করে দেয়া যেতে পারে। সারি থেকে সারি ৬০ সেন্টিমিটার এবং গাছ থেকে গাছ ৪৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে চারা রোপণ করতে হয়। চারা রোপণে মাটির গভীরতা ৫ থেকে ৬ সেন্টিমিটার রাখতে হয়।

পরিচর্যাঃ গুঁড়ি থেকে চারা উৎপন্ন হওয়ার পর যদি মূল জমিতে চারা রোপণে দেরি হয় তাহলে সেগুলো ভেজা মাটি ও ছায়া আছে এমন স্থানে রেখে দিতে হয়। চারাগুলো আঁটি বেঁধে বা কাছাকাছি রাখতে হয়। রোপণের সময় বা পরে কিছু দিন পর্যন্ত জমিতে বেশি পানি থাকার কারণে যাতে চারা হেলে না পড়ে সে জন্য মাটি কাদা করার সময় খুব বেশি নরম করা উচিত নয়। গাছ কিছুটা বড় হলে গোড়ার হলুদ হয়ে যাওয়া বা শুকিয়ে যাওয়া পাতা সরিয়ে ফেলতে হয়। ক্ষেতের আগাছা পরিষ্কার করে জমি পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। রোপণের এক থেকে তিন মাসের মধ্যে ক্ষেতে কোনো প্রকার আগাছা যেন না থাকে সে দিকে লক্ষ রাখতে হয়। পানি কচুর গাছে লতি আসার সময় ক্ষেতে পানি রাখা উচিত নয়। তবে একেবারে শুকনো রাখলেও আবার লতি কম বের হয় বা লতির দৈর্ঘø কম হয়। সে জন্য জো অবস্থা রাখতে হয়। সার প্রয়োগঃ হেক্টর প্রতি জৈবসার ১৫ টন, ইউরিয়া ১৫০ কেজি, টিএসপি ১২৫ কেজি, এমওপি ১৭৫ কেজি ব্যবহার করতে হয়। ইউরিয়া ছাড়া অন্যান্য সার জমি তৈরি শেষ চাষের সময় ছিটিয়ে মাটির সাথে ভালোভাবে মিশিয়ে দিতে হয়। ইউরিয়া সার দুই কিস্তিতে রোপণের ৩০ দিন ও ৬০ দিন পর সারির মাঝে ছিটিয়ে দিয়ে হালকা সেচ দিতে হয়। জমিতে দস্তা ও জিংকের অভাব থাকলে জিংক সালফেট ও জিপসাম সার হিসেবে ব্যবহার করতে হয়। জয়পুরহাট অঞ্চলের লতিকচুর চাষিরা প্রতিবার লতি সংগ্রহ করার পর ইউরিয়া সার উপরি প্রয়োগ করেন।


সেচ ও নিকাশঃ এটি একটি জলজ উদ্ভিদ হলেও দীর্ঘ সময় জলাবদ্ধতা সহ্য করতে পারে না। বিশেষ করে লতি উৎপাদনের সময় পানি ধরে রাখা ঠিক নয়। পানি থাকলে কম বা না থাকলে (শুধু জো অবস্থা থাকলে) বেশি লতি বের হয়।


খোন্দকার মেসবাহুল ইসলাম কৃষিবিদ

শনিবার, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

আমের যখন মুকুল ঝরে

আমের যখন মুকুল ঝরে







ফুল আসার ১৫ দিন আগে পর্যাপ্ত সেচ দিতে হবে। টিএসপি ও এমপি সার দিতে হবে দুই-তিন বছর বয়সের গাছে ২০০ থেকে ২৫০ গ্রাম, চার-পাঁচ বছর বয়সের গাছে ৩০০ থেকে ৩৫০ গ্রাম, ছয়-সাত বছর বয়সের গাছে ৪০০ থেকে ৫০০ গ্রাম, আট-নয় বছর বয়সের গাছে ৫০০ থেকে ৮০০ গ্রাম এবং ১০ বছরের ঊর্ধ্বে ৮৫০ থেকে এক হাজার ২০০ গ্রাম প্রতি গাছে। ফুল ফোটার সময় মেঘলা ও কুয়াশাচ্ছন্ন আবহাওয়া থাকলে পুষ্পমঞ্জরিতে পাউডারি মিলডিউ ও অ্যানথ্রাকনোজ রোগের আক্রমণ হতে পারে। এতে গাছের পাতা, কচি ডগা, মুকুল ও কচি আমে কালো দাগ পড়ে।
প্রতিকার হচ্ছে মুকুল আসার ১০ দিনের মধ্যে একবার প্রতি লিটার পানির সঙ্গে ১ মিলিলিটার রিপকর্ড বা সিমবুস ১০ ইসি এবং ০·৫ মিলিলিটার টিল্ট ২৫০ ইসি একত্রে মিশিয়ে আমের মুকুল, পাতা, কাণ্ডে স্প্রে করতে হবে। প্রাকৃতিক পরাগায়ণের জন্য আম বাগানে মৌমাছি পালন, বাগানের চারদিকে ফুলের গাছ রোপণ এবং বাগানে বিভিন্ন জাতের আমগাছ লাগানো প্রয়োজন। আমগাছে মুকুল আসার সময় হপার পোকা কচি অংশের রস চুষে খায়। ফলে মুকুল শুকিয়ে বিবর্ণ হয়ে ঝরে পড়ে। এ ছাড়া রস চোষার সময় পোকা আঠালো পদার্থ নিঃসৃত করে। এতে ফুলে পরাগরেণু আটকে পরাগায়ণে বিঘ্ন ঘটে। এ পোকা দমনের জন্য রিপকর্ড বা সিমবুস ও টিল্ট আগের নিয়মে স্প্রে করতে হবে। ত্রুটিপূর্ণ পূর্ণাঙ্গ ফুল এবং বর্ধিষ্ণু ভ্রূণের পুষ্টিহীনতা দূর করার জন্য মুকুল ধরার ১৫ দিন আগে উপরিউক্ত নিয়মে সার প্রয়োগ করতে হবে।
একই ডালে অনেক ফল ধরলে পুষ্টির জন্য ফলগুলো প্রতিযোগিতা করে বলে ফল ঝরে যায়। অতিরিক্ত ফল পাতলা করে দিতে হবে।হরমোন ও রাসায়নিক পদার্থ স্প্রে করলেও আমের মুকুল ও কচি আম ঝরে পড়া থেকে রক্ষা করা যায়। যেমন-আমের মুকুল গুটি বাঁধার দুই সপ্তাহ পর ২০ পিপিএম মাত্রায় ২৪-ডি স্প্রে করলে ভালো ফল পাওয়া যায়। আমের গুটি মসুর দানার মতো বড় হলে ১০ লিটার পানিতে দুই থেকে তিন মিলিলিটার প্লানোফিক্স স্প্রে করলে ফল ঝরা বন্ধ হয়।আমের ভেতর পোকাঃ প্রতিবছর টাঙ্গাইল, জামালপুর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুরসহ বিভিন্ন জেলায় আমের ভেতর পোকা থাকে। আমের বাইরে খোসায় কোনো চিহ্ন বা দাগ না থাকলেও ভেতরে জীবন্ত বড় বড় পোকা দেখে সবাই বি্নয় প্রকাশ করে। এ পোকা প্রতিরোধের এখনই উপযুক্ত সময়। এ পোকা দমন করতে হবে মুকুল ধরার আগে কিংবা মুকুল ধরার সময়। আমের ভেতর একমাত্র ম্যাঙ্গো উইভিল নামের পোকা থাকে। আশ্চর্যের বিষয় হলো আমের ত্বকে কোনো ছিদ্র থাকে না, এত বড় পোকা কীভাবে আমের ভেতর ঢুকল এবং আবদ্ধ অবস্থায় কীভাবে বেঁচে থাকে? আমের যখন মুকুল ধরে, তখন এ পোকা মুকুলে ডিম পাড়ে। মুকুল থেকে কচি আম হওয়ার সময় ফুলের ভেতরই ডিম ফুটে বাচ্চা বের হয়ে সঙ্গে সঙ্গে এটি কচি আমের ভেতর আস্তে আস্তে ঢাকা পড়ে। আমের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর ভেতরে পোকাও বড় হতে থাকে।
পোকা আমের ভেতর আম খেয়ে বেঁচে থাকে। সাধারণত মুকুল ধরার সময় তাপমাত্রা ২৫ থেকে ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস অথবা একটু বেশি এবং উচ্চ আর্দ্রতা থাকলে এ পোকা আক্রমণ করার আশঙ্কা বেশি থাকে। এক বছর আক্রমণ করলে প্রতিবছরই এ পোকা আক্রমণ করে। আমের ভেতর পোকা ঢুকে গেলে দমনের কোনো ব্যবস্থা নেই। এটি দমনের জন্য প্রতি ১০ লিটার পানিতে ১৫ মিলিলিটার ম্যালাথিয়ন বা সুমিথিয়ন মিশিয়ে মুকুল ধরার সময় মুকুলে স্প্রে করতে হবে। অথবা ৩০ মিলিলিটার ডায়াজিনন বা ১৫ মিলিলিটার ডাইমেক্রন প্রতি ১০ লিটার পানিতে মিশিয়ে মুকুলে স্প্রে করতে হয়। এ ছাড়া আমগাছের নিচে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ডিমের গাদা নষ্ট করতে হবে। আক্রান্ত আমগাছের নিচে পড়ে থাকা পাতা ও মুকুল পুড়িয়ে ফেলতে হবে। মুকুল ধরার সময় এলাকার সব আক্রান্ত গাছে একসঙ্গে কীটনাশক স্প্রে করতে হবে। অন্যথায় যে গাছে স্প্রে করা হবে না, সেই গাছে অন্য গাছ থেকে পোকা আক্রমণ করবে। এ ছাড়া আমের ফলন বাড়াতে হলে বছরে অন্তত দুবার সুষম মাত্রায় সার দিতে হবে। সেচ দিতে হবে প্রতি মাসে একবার। অপ্রয়োজনীয় ডালপালা ছেঁটে দিতে হবে। আমগাছের স্বভাব হচ্ছে প্রতি ডালে এক বছর পর পর আম ধরে। এ জন্য কোনো গাছে এক বছর ফলন ভালো হলে অন্য বছর ফলন কম হয় অথবা হওয়ার আশঙ্কা বেশি। গত বছর আমের ‘অফ ইয়ার’ ছিল, এ বছর প্রচুর মুকুল ধরার সম্ভাবনা আছে। ফলে মুকুল টিকিয়ে রাখার জন্য উপরিউক্ত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।


ফরহাদ আহাম্মেদ

রবিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

অগ্রাধিকার দিতে হবে কৃষিকে

অগ্রাধিকার দিতে হবে কৃষিকে





আজ খাদ্য নিরাপত্তার জন্য আরেকটি সবুজ বিপ্লব তথা পল্লী অবকাঠামোর উন্নয়ন ও আধুনিকীকরণ, দ্রব্যমূল্যের উর্ধµগতি নিয়ন্ত্রণসহ কৃষির প্রতিটি উপখাত যেমন- কৃষি, পোল্ট্রি, মৎস্য, পশুসম্পদ, ইত্যাদিও প্রতিটি ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত সমস্যার ও উন্নয়নের লক্ষ্য নির্ধারণ জাতির কাছে সময়ের দাবি।

পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে কৃষি ও কৃষকের জন্য নতুন সবুজ বিপ্লবের অধ্যায় সূচনার করা। পাশাপাশি খাদ্য ঘাটতি কাটিয়ে উঠে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা। কৃষির আধুনিক ও লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহার করা এবং জাতীয়ভাবে পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য কিছু সুপারিশ সরকারে কাছে তুলে ধরছি-

উচ্চফলনশীল জাতের ধান/হাইব্রিড ধান চাষ বাধ্যতামূলক করতে হবে এবং সেই সাথে দেশিয় জাতসমূহ গবেষণা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সংরক্ষিত জার্মপ্লাজম হিসেবে সংরক্ষণ করতে হবে। এক্ষেত্রে ধান বীজের নিশ্চয়তা প্রদানের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বীজ উৎপাদন বাড়াতে হবে এবং সেই সাথে বীজ উৎপাদন ও গবেষণায় বিভিন্ন কোম্পানিকে এগিয়ে আসতে হবে। কোম্পানিসমূহ যাতে IRRI, BINA, BAU, SAU, BSMRAU, PSTU সহ বিভিন্ন সরকারি গবেষণা ও কৃষি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাথে যৌথ ভাবে BRRI, FAO ইত্যাদি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কারিগরী সহায়তায় বিভিন্ন এলাকার কৃষি পরিবেশ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মানসম্মত ও উন্নত বীজ কৃষকের সামনে নিয়ে আসতে পারে সেজন্য প্রয়োজনে ঋণ সুবিধা প্রদান পূর্বক ভর্তুকির ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

সার বিপণন ও সার ব্যবস্থাপনা উন্মুক্ত করতে হবে। বাজারে সারের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে সেই সাথে জমির স্বাস্থ্য ভাল রাখার জন্য জমিতে শতকরা ৫০ ভাগ জৈবসার বা সবুজ সার ব্যবহারে কৃষককে উৎসাহিত করতে হবে। সারের ক্ষেত্রে কিছু নীতিগত পরিবর্তন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ যেমন- পোল্ট্রি বর্জ, শহরের বর্জøসহ অন্যান্য বর্জø যা আমরা যত্রতত্র ফেলে পরিবেশ দূষণ করছি বা বর্জ সমূহ ফেলে দিচ্ছি শুধু এমন উপাদান দ্বারা জৈবসার প্রস্তুত করলে দেশের মোট রাসায়নিক সারের ব্যবহার শতকরা ৩০ থেকে ৪০ ভাগ হ্রাস পাবে। যার ফলে শুধু ভর্তুকিবাবদই সরকারের সাশ্রয় হবে ৩৫০ থেকে ৪৫০ কোটি টাকা। সেই সাথে কৃষকের উৎপাদন ব্যয় যেমনি হ্রাস পাবে তেমনি ভোক্তাও ন্যায্যমূল্যে কৃষিপণ্য কিনতে পারবে। তাই দরকার জৈবসার ও রাসায়নিক সারের যৌথ ব্যবহার নিশ্চিত করে নীতিমালা প্রণয়ন।

কীটনাশকের যত্রতত্র ব্যবহারের পরিবর্তে সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনার আলোকে বায়ো পেস্টিসাইড ব্যবহার ও কীটপতঙ্গ প্রতিরোধী জাত উদ্‌ভাবনের জন্য গবেষণায় জোড় দিতে হবে। সেই সাথে ভেজাল কীটনাশক ও সার ব্যবহার করে বা খারাপ মানের বীজ ব্যবহার করে কৃষক যাতে প্রতারিত না হয় সেই জন্য DAE কে শক্তিশালীসহ আইনের কিছু নীতিগত পরিবর্তন করে দেশি-বিদেশি সার, বীজ ও কীটনাশক কোম্পানিসমূহের পণ্যের মান নিয়ন্ত্রণ ও টায়ালসহ গবেষণায় সম্পৃক্ততা বাড়াতে হবে।

কৃষি জমির ওপর অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়ন রোধে সরকার কৃষিজ জমির শ্রেণীবিন্যাস করে গ্রীনজোন বা কৃষি জোন ঘোষণা করলে পরিবেশ দূষন যেমনি রোধ হবে তেমনি কৃষি জমির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হবে।

সেচ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন সাধনসহ মৌসুমে বিদ্যুৎ ও ডিজেলের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করাসহ বিভিন্ন অঞ্চলের পাম্প পরিচালনার ক্ষেত্রে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ও BADC কর্মকর্তার সমন্বয়ে সমিতিসমূহ প্রতি এক বছর পরপর সমিতির ৭ জন বা ৯ জন সদস্যসহ কমিটি পরিবর্তিত হয়ে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার উপদেশে পরিচালিত হলে এবং পাম্পের লভ্যাংশ সমিতির সদস্যেও শেয়ারের ভিত্তিতে পরবর্তীতে পাম্পের উন্নয়নসহ কৃষি আধুনিক যন্ত্রপাতি সমন্বয়ে কৃষি উপকরণ ও সেবা সাপোর্ট সমিতির কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে-

কৃষিপণ্য বিপণন ও সংরক্ষণের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।

দেশের শতকরা ১০০ ভাগ ভূমির যথার্থ ব্যবহার নিশ্চিত করা।

কৃষি ভিত্তিক শিল্পের ঋণ সুবিধা বৃদ্ধি ও সুদের হার কমিয়ে আনা।

জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আগে থেকে বিকল্প জ্বালানি নিয়ে চিন্তা করা যার প্রেক্ষাপটে বিশ্বে ইতোমধ্যে বায়োডিজেল হিসেবে ভুট্টা, যাত্রফা, হংট্রি ইত্যাদির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে।

বাংলাদেশ রেলওয়ের মাধ্যমে কৃষিপণ্য পরিবহনের জন্য স্বল্পমূল্যে পরিবহনের ব্যবস্থা করা হয় এবং পণ্য পরিবহনের ভাড়া হতে একটা অংশ সরকার ভর্তুকিবাবদ ব্যয় করে যা জ্বালানিতে ভর্তুকি প্রদান করে পরিবহন ভাড়া নির্ধারণ করে, তবে সাধারণ জনগণ উপকৃত হবে এবং বাজারে কৃষিপণ্য মূল্যের স্থিতিশীলতা বৃদ্ধি পাবে। এক্ষেত্রে রেলওয়ে ওয়াগন ও পণ্যবাহী ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। এতে রেলওয়ে লাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেবার মান বাড়াতে দ্রুতগামী ট্রেনসহ অন্যান্য সুবিধা দিতে হবে। সেই সাথে যদি স্টেশন ভিত্তিক নিলাম কেন্দ্রিক কাঁচামালসহ সকল পণ্যের পাইকারী বাজার গড়ে উঠে তবে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ই উপকৃত হবে।

বার্ড ফ্লু নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। এ শিল্পে বিকাশে ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে হালাল উপায়ে প্রক্রিয়াজাতকরণ মাংস ও ডিম প্রক্রিয়াজাত করে ক্রয়-বিক্রয় বাধ্যতামূলক করলে এবং তা নিয়ন্ত্রণ ও তদারকিতে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে খামারি ও ভোক্তা উভয় উপকৃত হত। পাশাপাশি বার্ড ফ্লু প্রতিরোধী জাত উদ্‌ভাবনে গবেষণা করতে হবে।

মৎস্য খাতে ও পশুসম্পদ খাতে অবকাঠামো উন্নয়ন বার্ষিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণসহ আধুনিকায়ন আবশ্যক। এছাড়া ডেইরি খাতের উন্নয়নের জন্য সঠিক পরিকল্পনা সময়ের দাবি।

কৃষি শিল্প বিকাশের জন্য তথা সবুজ বিপ্লব ত্বরান্বিত করার জন্য এ শিল্পের কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতির ক্ষেত্রে শুল্কমুক্ত সুবিধা প্রদান আবশ্যক। কৃষির বিভিন্ন উপখাতের আলোকে কৃষক, ব্যবসায়ী, গবেষক, পরিকল্পনা প্রণেতা, লেখক, চিন্তাবিদ ও শিক্ষাবিদের সমন্বয়ে উপকমিটি ও কৃষির জাতীয় সবুজ বিপ্লব কমিটি গঠন করে পত্রিকা, টিভি, রেডিওতে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বিভিন্ন পরিকল্পনা, টেকসই প্রযুক্তি, উন্নত ও বিকল্প ভাবনা, ইত্যাদিও বিভিন্ন শ্রেণী হতে সংগ্রহ, পর্যালোচনা, পর্যবেক্ষণ ও সমন্বয় করে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গবেষক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনে ব্যবহার করে, কৃষির বিভিন্ন নীতিমালা পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করে জাতীয় গণতান্ত্রিক জরুরি কাজ হিসেবে তিন মাসের মধ্যে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তôবায়নের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। সেই সাথে কৃষিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার খাত হিসেবে মর্যাদা দিয়ে ক্ষুধা, দারিদ্র্যতা, সন্ত্রাস, দুর্নীতিমুক্ত আত্মনির্ভর উন্নত সমুজ্জ্বল সবুজ বাংলার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে স্বাধীনতার স্বপ্নের সার্থকতার প্রজন্ম হিসেবে নতুন ইতিহাস গড়তে।
- কৃষিবিদ মোঃ ফসিউল আলম ভূঁইয়া মাসুম

দেশি মাছ রক্ষার উপায় -৫


দেশি মাছ রক্ষার উপায় -৫






(পূর্ব প্রকাশের পর)

গত বছর চিতল মাছের কৃত্রিম প্রজননের উপর কাজ করেছিলাম। বিভিন্ন মাত্রায় ডোজ দিয়ে চিতলের কৃত্রিম প্রজনন করতে গিয়ে দেখা গেছে, চিতল মাছকে পি·জি· হরমোন দিয়ে ইঞ্জেকশন করার পর স্ত্রী চিতল মাছ ডিম পাড়লে পুরুষ চিতলের ভূমিকা খুবই কম। একইভাবে ফলি মাছের ক্ষেত্রেও চাপ প্রয়োগ পদ্ধতিতে পুরুষ মাছকে কেটে র্স্পাম মিশাতে হয়। তাই চাপ প্রয়োগে ডিম বের করার পর পুরুষ চিতল/ফলি মাছের টেস্টিজ কেটে র্স্পাম মিশিয়ে সফলতা পেলেও নিম্নলিখিত কারণে এ পদ্ধতিটি লাগসই বলে আমার কাছে মনে হয়নি।

১· চিতল মাছের ডিমের পরিমাণ খুবই কম এবং ডিমের আকার বেশ বড়। এক একটি ডিমের আকার প্রায় ছোট মার্বেলের মত। একটি বড় চিতল মাছে ৩০০ থেকে ৫০০ ডিমের বেশি থাকে না।

২· প্রাকৃতিকভাবে ডিম দিতে প্রত্যেকবার পুরুষ চিতলের র্স্পামের জন্য একটি পুরুষ চিতল মাছ কাটতে হয় যা অল্প সংখ্যক ডিমের জন্য ঠিক নয়।

৩· চিতল মাছের ডিম ফুটতে তাপমাত্রাভেদে প্রায় ১৫ দিন সময় লাগে। অন্যদিকে কার্প বা রুই জাতীয় মাছের ডিম ফুটতে ১৮ থেকে ২৪ ঘণ্টার উপরে লাগে না। দীর্ঘদিন সিস্টার্ণে ডিম রেখে অল্পসংখ্যক বাচ্চা উৎপাদন করে ব্যবসায়িকভাবে খুব একটা লাভবান হওয়া যায় না।

এ সব বিভিন্ন কারণে চিতল মাছের কৃত্রিম প্রজননে আশাপ্রদ ফলাফল পাওয়া যায়নি। কৃত্রিম প্রজননের পাশাপাশি পুকুরে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতেও চিতল মাছের বাচ্চা ফুটানো হয়। দুটি পরীক্ষা থেকে দেখা গেছে প্রাকৃতিকভাবে পুকুরেই চিতল মাছের বাচ্চা ফুটানোই ভাল।

পুকুরে চিতল মাছের পোনা উৎপাদন পদ্ধতিঃ জানুয়ারির দিকে প্রথমে পুকুরকে ভালভাবে শুকিয়ে (১৫ দিন) রাখতে হবে। এর ফলে পুকুরের তলায় এক ধরনের ঘাসের সৃষ্টি হলে পানি দিতে হবে। পানি নীচের ঘাসগুলো আস্তেô আস্তে বড় হতে হতে এক সময় পানির উপর চলে আসবে। এভাবে প্রাকৃতিক আশ্রম তৈরি হবে পুকুরে। এ ভাবে মাস খানেক পর অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসে পুকুরে চিতল মাছের মাতৃ মাছ এবং পুরুষ ব্রুড মাছ মজুদ করতে হবে। মজুদ ঘনত্ব হবে প্রতি শতাংশে সর্বোচ্চ ৩টি। ব্রুড মাছ মজুদের পর খাবার হিসেবে কার্প বা রুই জাতীয় মাছের ধানী পোনা পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে। চিতল মাছ কিছুটা রাক্ষুসে স্বভাবের হলেও বড় মাছ খায় না। খাবার হিসেবে ছোট ছোট মাছ খেতে পছন্দ করে। কার্প জাতীয় মাছের ধানী পোনাও ছাড়াও তেলাপিয়ার ছোট ছোট বাচ্চা খেতে পছন্দ করে। সে জন্য পুকুর প্রস্তুতি এবং পানি দেয়ার পর কিছু সংখ্যক ব্রুড তেলাপিয়া ছাড়তে হবে। তাতে তেলাপিয়া প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে বাচ্চা দেয়া শুরু করবে। আর সে বাচ্চা চিতলের খাবার হিসেবে চলে যাবে।

চিতল মাছ সাধারণত এপ্রিলের শেষের দিকে অর্থাৎ জুলাই মাস পর্যন্ত অমাবস্যা বা পূর্ণিমার রাতে পুকুরে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে ডিম দিয়ে থাকে। আর সে জন্য প্রজনন প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করার জন্য এপ্রিলের শেষ দিক হতে জুলাই পর্যন্তô পুকুরে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানির প্রবাহ দেয়া উচিত। তাতে চিতল মাছের প্রজনন প্রক্রিয়ায় দ্রুত সাড়া দিয়ে ডিম পাড়া তরান্বিত হবে। চিতল মাছের ডিম আঁঠাল। আর সে জন্য চিতলের ডিম সংগ্রহের জন্য বিশেষ কিছু ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। ডিম সংগ্রহের জন্য কাঠের ফ্রেম বানিয়ে দিতে হবে। কাঠের ফ্রেম অনেকটা ছোট নৌকার মত এবং তা ডুবিয়ে রাখতে হবে। চিতলের ডিম সংগ্রহের জন্য এ ব্যবস্থা নিলেই চলবে। এ প্রক্রিয়াটি এপ্রিলের আগেই করে রাখতে হবে। মে মাস থেকেই চিতল মাছ ডিম পারতে শুরু করবে। সাধারণত বর্ষা মৌসুমের প্রতি অমাবস্যা বা পূর্ণিমা রাতে এরা ডিম পারে। অমাবস্যা বা পূর্ণিমার ২/৩ দিন পর কাঠ দিয়ে বানানো নৌকাটিকে পানির উপর তুলে দেখতে হবে ডিম দিয়েছে কি-না। যদি ছোট নৌকাতে ডিম দেখা যায় তাহলে ডিমসহ নৌকাটিকে নার্সারি পুকুরে স্থানান্তôরিত করতে হবে।

নার্সারি পুকুর প্রস্তুতিঃ চিতলের ডিমের সংখ্যা যেহেতু কম সেহেতু ছোট ছোট নার্সারি প্রস্তôাত করতে হবে। সাধারণত ৫ শতাংশের পুকুর নার্সারির জন্য নির্বাচন করতে হবে। প্রথমে পুকুর শুকিয়ে পুকুরের তলায় চাষ দিয়ে শ্যালো দিয়ে পরিষ্কার পানি ২/৩ ফুট পানি দিয়ে পূর্ণ করতে হবে। তারপর চিতলের ডিমসহ ছোট নৌকাটিকে নার্সারি পুকুরে খুব তাড়াতাড়ি করে সর্তকতার সাথে এনে ডুবিয়ে রাখতে হবে। যেহেতু চিতলের ডিম ফুটতে প্রায় ১৫ দিনের মত লাগে সেহেতু ডিম দেখে নার্সারি পুকুর প্রস্তুত করা ভাল। আর তা না হলে আগেই নার্সারি পুকুর প্রস্তুত হয়ে গেলে পানি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। পানি পরিষ্কার না হলে চিতলের ডিমে ফাঙ্গাস পড়তে পারে। এ ভাবে ডিম সংগ্রহ করে নার্সারিতে নেয়ার পর তাপমাত্রাভেদে ১২ থেকে ১৫ দিনের মধ্যেই ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হবে। বাচ্চা ফুটার পর খাদ্য হিসেবে কার্প জাতীয় মাছের রেনু পুকুরে দিতে হবে। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, চিতলের বাচ্চা পূর্ণাঙ্গভাবে ফুটার পর পরই প্রায় ১/২ ইঞ্চি সাইজের হয়ে থাকে। এভাবে নার্সারি পুকুরে সপ্তাহ দুয়েক রাখার পর প্রায় ৩ ইঞ্চি সাইজের হয়ে থাকে। এরপর চিতলের পোনাকে চাষের পুকুরে ছাড়তে হবে। নার্সারি পুকুরে ১ ইঞ্চি থেকে ২ ইঞ্চি সাইজের ফাঁসের জাল রাখতে হবে যাতে সাপ আটকে যায়।

চিতলের চাষ পদ্ধতিঃ আমাদের দেশে এখনও চিতলের একক চাষ পদ্ধতি চালু হয়নি। পোনা প্রাপ্তির অভাবে মিশ্রভাবে বিচ্ছিন্নভাবে চিতলের চাষ শুরু হয়েছে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে প্রতি ৫ শতাংশে অন্যান্য মাছের সাথে ১টি করে চিতল দিলে ১ বছরে প্রায় ২ কেজি ওজনের হয়ে থাকে। এর জন্য বাড়তি খাবারের প্রয়োজন নেই।

চিতলের রোগবালাইঃ নীবিড় পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে চিতল মাছের প্রজননের সময় পুরুষ চিতল মাছ স্ত্রী চিতল মাছের সাথে জড়াজড়ি করে একটি আরেকটিকে আক্রান্তô করে ফেলে। বিশেষ করে এদের মুখের দিকে কাঁটা বা বুকের নীচে কাঁটা দিয়ে একে অপরকে নিজের অজান্তেôই আক্রান্তô করে যা পরবর্তীতে সমস্তô শরীরে ক্ষত রোগ হিসেবে দেখা দিতে পারে। এজন্য প্রত্যেকবার ডিম দেয়ার পর পুকুরে পটাসিয়াম পার-ম্যাঙ্গানেট ছিটিয়ে দেয়া প্রয়োজন। এতে প্রজননের পর আক্রান্তô মাছগুলো দ্রুত আরোগ্য লাভ করবে। মিশ্র চাষে চিতলের রোগ বালাই নেই বললেই চলে।

উপরোল্লেখিত পদ্ধতি অনুসরণ করে করে যে কেউ চিতলের পোনা উৎপাদন করতে পারবে। যা মিশ্রচাষে খুব ভাল মুনাফা ঘরে আসবে পাশাপাশি চিতলের বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে।

- এ· কে· এম· নূরুল হক
শম্ভুগঞ্জ, ময়মনসিংহ

পতিত জমিতে হলুদ চাষ


পতিত জমিতে হলুদ চাষ





হলুদগুলো দেখে মনটা ভরে গেল নিয়ামত আলীর। ভাঙ্গা হলুদের রঙ যেন সোনা রঙের মত চকচক করছে। ব্যপারটা প্রথমে তিনি বুঝে উঠতে পারেননি। অবহেলায় ফেলে রেখেছিলেন বাড়ির দক্ষিণপাশে পুকুর আর বাড়ির মাঝখানের বেশকিছুটা পতিত জমি। রুহুল মিয়ার পরামর্শে তিনি হলুদ চাষ করেন। এতে বীজের টাকা ছাড়া তেমন কোন খরচ নেই। হলুদের বীজ সংরক্ষণ করার কোন প্রয়োজনও নেই।

হলুদ একটি লাভজনক ফসল। এটা লাগানোর পর ৮ থেকে ১০ মাস সময় লাগে তুলতে। হলুদ চাষ করতে গেলে সেচ, কীটনাশক এবং পরিচর্যার প্রয়োজন পড়ে না। অনুর্বর ভিটে মাটি অথবা পতিত বেলে দো-আঁশ মাটিতে হলুদ ভাল জন্মে। ভাল ফলন হলে ১ বিঘা জমিতে প্রতি বছর কাঁচা ২৫ থেকে ৩০ মণ এবং শুকনো ১০ থেকে ১২ মণ হলুদ পাওয়া যায়। জমিতে ভালভাবে চাষ দিয়ে পিলি তৈরি করে বীজ বপন করতে হয়। বীজ বপনের পর কখনও কখনও আগাছা পরিষ্কার করার দরকার হয়। জমি থেকে হলুদ তোলার পর গোড়ার সাথে মোথার অংশটুকুই হল বীজ। মাঘ-ফালগুন মাসে ক্ষেত থেকে হলুদ তোলার পর জমি ফেলে রাখতে হয় ২ থেকে ৩ মাস। বছরে একবার ফলন হয় বলে হলুদ চাষে কৃষকদের অনিহা। হলুদের বাজার দরও কম না। শুকনো আস্তô হলুদ ৮০ থেকে ৯০ টাকা হলেও শুকনো হলুদের গুঁড়া ১০০ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে। বছরে যদি দুইবার হলুদ তোলা সম্ভব হলে এটি একটি লাভজনক ফসল হিসেবে বিবেচিত হত এবং চাষিদের জন্য ভাল হত।

শনিবার, ৭ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

ইউরিয়া স্প্রে করলে ফলনে প্রভাব পড়ে না!


ইউরিয়া স্প্রে করলে ফলনে প্রভাব পড়ে না!






ইউরিয়ার দ্রবণ স্প্রে করলে কাজ হয় না এবং এটা বিজ্ঞানসম্মতও নয়। ইউরিয়া পানিতে গুলিয়ে দ্রবণ তৈরি করার পর পানির সঙ্গে বিক্রিয়া করে অ্যামোনিয়াম হাইড্রো-অক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইড হয়। ইউরিয়া দ্রবণ স্প্রে করার সময় অ্যামোনিয়া হাইড্রো-অক্সাইড ভেঞ্চ অ্যামোনিয়া গ্যাস ও পানি হয়। বিক্রিয়া রোদে ইউরিয়ার পানি স্প্রে করলে আরও দ্রুত ভেঙে অ্যামোনিয়া গ্যাস হবে। এই অ্যামোনিয়া গ্যাসের ঘনত্ব ৮ দশমিক ৫ এবং বাতাসের ঘনত্ব ১৪ দশমিক ৪। অতএব বাতাসের চেয়ে অ্যামোনিয়া গ্যাস হালকা বলে বাতাসে উড়ে যাবে। গাছের কাজের লাগবে না। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ও আইএফডিসির গবেষণালব্ধ ফলাফল থেকে দেখা গেছে, ইউরিয়া ছিটিয়ে প্রয়োগ করলে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ ভাগ গাছ গ্রহণ করতে পারে। বাকি ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ অপচয় হয়। ইউরিয়া বাতাসের সংস্পর্শে এলে ৬০ থেকে ৭০ ভাগ বাষ্পীভূত পদ্ধতিতে অ্যামোনিয়া গ্যাস, নাইট্রিফিকেশন, ডিনাইট্রিফিকেশন এবং নাইট্রোজেন ও নাইট্রাস অক্সাইড গ্যাস হিসেবে উড়ে যায়। বাকি পাঁচ থেকে ১০ শতাংশ নাইট্রেট হিসেবে চুইয়ে ভূগর্ভের পানির স্তরে মিশে যায়। বাষ্পীভূত অপচয় রোধের জন্য গুটি ইউরিয়া মাটির গভীরে প্রয়োগ করা হয়। ইউরিয়ার পানি বাষ্পীভূত হয় বলে পাতা বা কাণ্ডের ভেতরের জাইলেম ও ফ্লোয়েম টিস্যুতে পৌঁছাতেই পারবে না। সাধারণভাবে দেখা যায়, ইউরিয়া উন্মুক্ত অবস্থায় রাখলে গলে ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়। দুই· মাটিতে ইউরিয়া সার প্রয়োগ করলে শিকড়ের নরম মূলত্বক দিয়ে রাসায়নিক প্রতিস্থাপন বিক্রিয়ায় অ্যামোনিয়াম আয়ন কর্টেক্সে প্রবেশ করে। ওয়াকারের তত্ত্ব অনুসারে শিকড়ের শ্বসন প্রক্রিয়ায় সৃষ্ট কার্বন ডাই-অক্সাইড পানির সঙ্গে বিক্রিয়া করে কার্বনিক এসিড তৈরি করে। কার্বনিক এসিড ভেঙে হাইড্রোজেন আয়ন ও বাই-কার্বনেট আয়ন জোড়া সৃষ্টি হয়। এই আয়ন জোড়া কর্দমপৃষ্ঠে প্রতিস্থাপিত হয়ে হাইড্রোজেন আয়ন ও অ্যামোনিয়াম আয়ন দ্বারা স্থানান্তরিত হয়ে নতুন আয়ন জোড়া সৃষ্টি হয়। এই আয়ন জোড়া মূলের পৃষ্ঠের হাইড্রোজেন আয়নের সঙ্গে বিনিময় করে অ্যামোনিয়াম আয়ন মূলের মধ্যে প্রবেশ করে। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার জন্য মাটির পরিবেশ প্রয়োজন। পাতা বা কাণ্ডে মাটির এই পরিবেশ সৃষ্টি হয় না। অপরদিকে পাতার ওপরে শক্ত কিউটিকলের স্তর থাকায় অ্যামোনিয়াম আয়ন প্রবেশ করতে পারবে না। পত্ররন্ধ্র দিয়ে অ্যামোনিয়াম আয়ন প্রবেশ করতে পারবে না, কারণ পত্ররন্ধ্রের কাজ হচ্ছে গাছের অতিরিক্ত পানি বের করে দেওয়া, বাতাস থেকে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্রহণ এবং অক্সিজেন ত্যাগ করা। উল্লেখ্য, ইউরিয়া থেকে অ্যামোনিয়াম আয়ন গ্রহণের একমাত্র মাধ্যম হচ্ছে শিকড়। অধিকাংশ গাছের পত্ররন্ধ্র পাতার নি্নপৃষ্ঠ থাকে বলে অ্যামোনিয়াম আয়ন প্রবেশ করতে পারবে না। তিন· গাছের অধিকাংশ পাতা তৈলাক্ত বলে পাতায় পানি অথবা ইউরিয়া স্প্রে করা পানি লেগে থাকে না। স্প্রে করার সঙ্গে সঙ্গে অ্যামোনিয়া উড়ে যায়, শুধু পানি নিচে পড়ে। দেশের ৮০ শতাংশ ইউরিয়া ধানক্ষেতে প্রয়োগ করা হয়। ধানের পাতায় ইউরিয়ার পানি লেগে থাকার প্রশ্নই ওঠে না। চার· ইউরিয়া বিষাক্ত পদার্থ বলে প্রয়োগের সময় গাছের কাণ্ড, পাতা ও শিকড়ে লাগলে পুড়ে যায়। এ জন্য কাণ্ড ও পাতা ভেজা অবস্থায় ইউরিয়া প্রয়োগ করা নিষেধ। শিকড় থেকে একটু দূরে প্রয়োগ করতে হয়। ইউরিয়ার ঘন দ্রবণ স্প্রে করলে পাতা ও কাণ্ড পুড়ে যেতে পারে। ইউরিয়া দ্রবণ স্প্রে করলে গাছের ভেতর প্রবেশ করবে না। তাহলে ঘাটাইলে ফলন ভালো হলো কেন? এর কারণ হলো, ওই এলাকা পাহাড়ি হওয়ায় মাটি উর্বর। প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো বরই, আম, জাম, কাঁটাল প্রভৃতি ফলগাছে কেউ কখনো সার দেয় না, কিন্তু ফল ধরে প্রচুর। আর ঘাটাইলের ওই গ্রামের মাটি উর্বর হওয়ায় ফলন বেশি হওয়াটা স্বাভাবিক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো, ইউরিয়া দ্রবণ স্প্রের কার্যকারিতা বিজ্ঞানসম্মত নয়।

ফরহাদ আহম্মেদ

সবজির রোগ নিয়ন্ত্রণে বায়োফিউমিগেশন


সবজির রোগ নিয়ন্ত্রণে বায়োফিউমিগেশন কৃষির নয়া প্রযুক্তি

কম্বোডিয়ার একটি সবজি বীজতলায় বায়োফিউমিগেশন করা হচ্ছে




টমেটো, বেগুন, মরিচ ইত্যাদি সবজিতে অন্যান্য রোগের পাশাপাশি গোড়া পচা, ব্যাকটেরিয়াজনিত ঢলে পড়া ও চারার মড়ক প্রধান সমস্যা। সবগুলোই মাটিবাহিত রোগ। এসব রোগের জীবাণু মাটিতে দীর্ঘকাল বেঁচে থাকতে পারে। জীবাণু থাকা মাটিতে সুস্থ সবল চারা লাগালেও সেসব চারা জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হয়ে রোগ সৃষ্টি করতে পারে। অনুকূল পরিবেশ পেলে এ রোগ মহামারী আকার ধারণ করে এবং সম্পূর্ণ চারা বা গাছ ধ্বংস করে ফেলে। চারার মড়ক বা ড্যাম্পিং অফ প্রায় সব সবজি ফসলেরই একটি মারাত্মক রোগ। বীজতলায় বীজ গজানোর পর মাঝে মাঝে চারার মাটিসংলগ্ন স্থানে পচন দেখা যায়। পচা জায়গা থেকে চারা ভেঙে ঢলে পড়ে এবং শেষে মারা যায়। আর জমিতে চারা রোপণের পর যেকোনো বয়সের সবজিগাছই চারার মতো একইভাবে মাটিসংলগ্ন স্থান থেকে পচতে শুরু করে এবং ঢলে পড়ে। ব্যাকটেরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগে আক্রান্ত গাছ হঠাৎ নেতিয়ে পড়ে। এ রকম আরো বেশ কিছু রোগ আছে যেগুলো মাটিবাহিত এবং শুধু রোগনাশক স্প্রে করে ভালো করা যায় না। সেজন্য বিজ্ঞানীরা মাটিতে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত রোগজীবাণুকে ধ্বংস করতে মাটি শোধনের এমন এক পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন যা প্রয়োগ করে সবজি ফসলকে মাটিবাহিত বিভিন্ন রোগের আক্রমণ থেকে বাঁচানো যেতে পারে। একধরনের গাছ দিয়েই এই চিকিৎসা করা যায়। এই গাছও আর এক ধরনের ফসল। কপিগোত্রীয় বিভিন্ন গাছ বিশেষ করে মূলা, সরিষা, কপি ইত্যাদি গাছ মাটিতে মিশিয়ে দিলে তা থেকে মাটিতে এক ধরনের গ্যাস নিঃসরিত হয়। আইসো থায়োসায়ানেট (আইটিসি) নামের সেই বিষাক্ত গ্যাসই মাটিতে লুকিয়ে থাকা জীবাণুদের ধ্বংস করে দেয়। যেহেতু গাছ মানে জীব (বায়ো), সজীব উপকরণ ব্যবহার করে তার গ্যাসকে (ফিউম) কাজে লাগিয়ে মাটি শোধন করা হচ্ছে তাই এ পদ্ধতির নাম দেয়া হয়েছে ‘বায়োফিউমিগেশন’। কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে এ পদ্ধতির বাস্তব প্রয়োগ শুরু হয়েছে। কম্বোডিয়ার একটি আইপিএম সবজি কৃষক মাঠ স্কুলে গিয়ে দেখা গেল, সে স্কুলের চাষি ভাইয়েরা এ পদ্ধতি ব্যবহার করে মাঠে পরীক্ষা স্থাপন করেছেন। যে বীজতলায় বায়োফিউমিগেশন করা হয়নি সেখানকার টমেটো ও কপির চারাগুলো ড্যাম্পিং অফ রোগে আক্রান্ত অথচ বায়োফিউমিগেশন করা বীজতলায় ড্যাম্পিং অফ রোগের আক্রমণ নেই বললেই চলে।
মাটিতে বসবাসকারী বিভিন্ন বালাই ও রোগজীবাণুকে এ ধরনের বায়োসাইড ব্যবহার করে দমিয়ে রাখার কৌশল একেবারেই নতুন, তবে ব্যয় সাশ্রয়ী। কিন্তু গাছ হিসেবে চওড়া পাতার যেকোনো জাতের সরিষাগাছ এ কাজের জন্য উত্তম। অগত্যা শিয়ালমূত্রা আগাছা দিয়েও এ কাজ চালানো যায়। এ আগাছা আমাদের দেশে রাস্তার ধারে ও ডোবানালার পাশে খুব জন্মে। ব্যাপকভাবে বিশাল জমিখণ্ডে হয়তো এ পদ্ধতির ব্যবহার লাভজনক হবে না, তবে বীজতলার ছোট্ট একখণ্ড জমিতে এ পদ্ধতি ব্যবহার করে চারার মড়ক নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। ইন্ডিয়ান সরিষা ভালো ও বীজের দাম কম। তবে মূলা ও চীনা সরিষা শাকও এ কাজে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে।
বায়োফিউমিগেশন করতে হলে প্রথমে বীজতলার উপরের মাটি ৭.৫ থেকে ১০ সেন্টিমিটার গভীর করে তুলে ফেলতে হবে। মাটি তোলার পর জায়গাটা একটা অগভীর চৌবাচ্চার মতো মনে হবে। তারপর বাড়ন্ত বয়সের সরিষা বা কপি (চীনা বাঁধাকপি/বাটিশাক) সংগ্রহ করে কুচি কুচি করে কাটতে হবে। কুচি যত ছোট হবে তত বেশি আইটিসি গ্যাস বের হবে। তারপর প্রতি বর্গমিটার জায়গার জন্য ৫ কেজি হারে কাটা কুচিগুলো মাটি তুলে ফেলা জায়গায় পুরু করে বিছিয়ে দিতে হবে। এরপর তুলে রাখা মাটি এর ওপর দিয়ে মাটির সাথে গাছের কুচিগুলো মিশিয়ে দিতে হবে। মেশানোর পর সেখানে পানি দিয়ে ভালো করে ভেজাতে হবে। ভেজানোর পর সম্পূর্ণ বীজতলার মাটি কালো মোটা পলিথিন দিয়ে ঢেকে পলিথিনের চার পাশ মাটির মধ্যে পুঁতে দিতে হবে যাতে ভেতরের কোনো গ্যাস বাইরে না আসে। এভাবে ২ থেকে ৩ সপ্তাহ রেখে দিলে গাছের কুচিগুলো পচে গ্যাস ছাড়বে ও সেই গ্যাস মাটির ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক ও কৃমিকে মেরে ফেলবে। উপরন্তু গাছ পচে সবুজ সারের মতো মাটিতে জৈব পদার্থ যোগ করে উর্বরতা বাড়াবে। পরে পলিথিন উঠিয়ে ফেলে দু-একদিন রোদ খাওয়ানোর পর ফের চাষ দিয়ে বীজতলা তৈরি করে সেখানে বীজ বপন করলে রোগ কম হবে। এ পদ্ধতি অনুসরণ করে ব্যাকটেরিয়াজনিত ঢলে পড়া রোগ ৬০ থেকে ৭০ ভাগ কমানো সম্ভব হয়েছে। এ ছাড়া কৃমিজনিত শিকড়ে গিঁট রোগও এ পদ্ধতিতে কমানো যায়। বেলে মাটিতে এ পদ্ধতি ব্যবহার করে বেশি সুফল পাওয়া যায়।
মৃত্যুঞ্জয় রায়

পঞ্চগড়ে কমলা চাষ


পঞ্চগড়ে কমলা চাষ





অল্প পরিশ্রমে বেশি লাভ করা যায় এমন ফসল আবাদের দিকে নজর থাকে সবারই। কমলা তেমন একটি ফসল যা চাষে পরিশ্রম হয় কম, খরচও খুব একটা বেশি না। কিন্তু লাভ আসে ষোলো আনা। কথাটা অন্য এলাকার চাষি ভাইদের মতো জেনে গেছেন পঞ্চগড় এলাকার চাষি ভাইয়েরাও। তারাও এগিয়ে এসেছেন কমলা চাষের দিকে। তাদেরই একজন ইসমাইল হোসেন। বাড়ি তার পঞ্চগড় সদর উপজেলার জগদল বাজারে। চাষাবাদের পাশাপাশি কনফেকশনারীর ব্যবসাও করেন। যা হোক, তিনি ২০০৫ সালে বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় ১৭টি কমলার চারা রোপণ করেন। মাত্র দু’বছরের মাথায় গাছগুলো ফল দেয়া শুরু করেছে। স্বাদে, গন্ধে ও আকৃতিতে বাজারের অন্যান্য কমলার চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। এ বছর তার প্রতিটি কমলাগাছে প্রায় ২০০টি করে কমলা ধরেছে। তিনি আরো ৬৬ শতক জমিতে কমলার চারা রোপণ করবেন বলে জমি তৈরি করছেন।
ইসমাইল হোসেনের দেখাদেখি সম্প্রতি পঞ্চগড়ে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে কমলার চাষ শুরু হয়েছে। জেলার কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, মাটিতে অ্লের (পিএইচ) মান সাড়ে চার থেকে সাড়ে পাঁচ পর্যন্ত থাকলে সেই জমিতে কমলার চাষ করা যাবে। এ দিক দিয়ে পঞ্চগড় এলাকার জমি খুবই উপযুক্ত।
জেলার চাষি ভাইদের কমলা চাষে আগ্রহ দেখে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর উন্নত কমলা চাষ প্রকল্প হাতে নিয়েছে। প্রকল্পের কর্মকর্তা আব্দুর রব জানান, কৃষি বিভাগ জেলায় পাঁচ বছরমেয়াদী কমলা চাষ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। ২০০৬ সালে এ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। এ পর্যন্ত জেলার ৪ হাজার ৮৮৮টি চারা রোপণ করা হয়েছে। আটোয়ারী উপজেলার জুগিকাটা গ্রামের শাহাজাদা, সদর উপজেলার মীরগড়ের হাফেজ মোঃ মজিবর রহমান, তেঁতুলিয়া পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি মখলেছার রহমান, আটোয়ারীর পানিশাইল গ্রামের মোঃ আব্দুর রশিদ এবং বোদা উপজেলার সর্দারপাড়া গ্রামের তরিকুল ইসলাম প্রত্যেকে ৬৬ শতক জমিতে কমলার চারা রোপণ করেছেন। কমলাচাষিদের প্রত্যেককে ১৭০টি করে চারা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সরবরাহ করেছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পঞ্চগড় সদর, তেঁতুলিয়া, আটোয়ারী ও বোদা উপজেলার ৫৪০ জন চাষিকে কমলা চাষের জন্য প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। জেলা কৃষি অফিসের ৩০ জন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাকেও এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে।
এ ছাড়া জেলার সদর উপজেলার বলেয়াপাড়া আব্দুল গফফার চৌধুরী, কাহারপাড়া গ্রামের জিতেন্দ্রনাথ, বড়ভিটার সালাউদ্দিন, জেলা শহরের কামাতপাড়ার আব্দুল জলিল, সিপাইপাড়া এলাকার আব্দুর রহমান, অচিন্ত্য কুমার কারকুন নিজস্ব উদ্যোগে বাড়িতে কমলার চারা রোপণ করেছেন। এসব গাছের উৎপাদিত কমলার রঙ, আকার, স্বাদ ভারতীয় কমলার মতো বলে তারা জানিয়েছেন।
আসাদুজ্জামান আসাদ

লবণাক্ত ধানী জমিতে সারব্যবস্থাপনা


লবণাক্ত ধানী জমিতে সারব্যবস্থাপনা



যে জমিতে চার ডিএস/মিটার বা এর অধিক মাত্রার লবণ থাকে কৃষিতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে লবণাক্ত মাটি বলে। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় ১৩টি জেলায় (সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ভোলা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার) ৮.৩০ লাখ হেক্টর আবাদি জমিতে বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততা রয়েছে, যা ফসল উৎপাদনে হুমকিস্বরূপ।
লবণাক্ত জমিতে কী ঘটেঃ মানুষের ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের রোগীকে যেমন লবণ খেতে নিষেধ করা হয় এবং তার পরিবর্তে পটাশিয়ামসমৃদ্ধ খাবার (ডাবের পানি, কলা, গোল আলু) বেশি করে খেতে বলা হয়। সোডিয়ামসমৃদ্ধ লবণাক্ত জমির ক্ষেত্রেও কৃষি বিজ্ঞানীরা একই কথা বলে থাকেন। কেননা, অতিমাত্রায় সোডিয়াম লবণ থাকায় লবণাক্ত জমিতে গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং ফলন কমে যায়। সোডিয়াম লবণের এই বর্ধিত মাত্রাকে প্রতিরোধ করতে এবং মাটির অন্যান্য খাদ্যোপাদানকে গাছের জন্য খাবার উপযোগী করতে অধিক মাত্রায় পটাশিয়াম সরবরাহের প্রয়োজন হয়। লবণাক্ততার কুফল প্রতিরোধে এবং মাটির ভৌত গুণাবলি উন্নত করার জন্য জৈব সার ব্যবহারের আবশ্যকতা দেখা দেয়।
লবণাক্ত ধানী জমিতে সার ব্যবস্থাপনায় বিশেষজ্ঞের পরামর্শঃ প্রথমেই চাষি ভাইদের করণীয় হলো মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সারের চাহিদা জেনে নেয়া। এ ক্ষেত্রে মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাঠপর্যায়ের অফিস থেকে সাহায্য নেয়া যেতে পারে। মাটি পরীক্ষাভিত্তিক রাসায়নিক সারের এই নিরূপিত মাত্রার সাথে অতিরিক্ত ৫ টন/হেক্টর জৈব সার বা ধৈঞ্চাসার ব্যবহার করলে প্রায় ১ টন ফলন বেশি পাওয়া যাবে। কেননা জৈব সারের মতো ধৈঞ্চাসারে নাইট্রোজেনের পাশাপাশি যথেষ্ট ক্যালসিয়াম এবং পটাশিয়াম রয়েছে। ধৈঞ্চার এই দু’টি উপাদান লবণাক্ত মাটির অতিরিক্ত সোডিয়ামকে প্রশমিত করে খাদ্যোপাদানের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করে। ফলে ধানগাছের বাড়-বাড়তি ভালো হয় এবং ফলন বৃদ্ধি পায়। তাই জৈব ও রাসায়নিক সার সম্মিলিত ব্যবহার করলে ধানের ফলন বেশি পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে ধানের পূর্ণ কুশি অবস্থা আসার আগেই যদি মাটি পরীক্ষাভিত্তিক সারের মাত্রার সাথে অতিরিক্ত ২০ কেজি হেক্টর পটাশিয়াম প্রয়োগ করা যায়, তবে জৈব-অজৈব সারের সমন্বয়ে প্রয়োগকৃত সারের চেয়েও বেশি ফলন পাওয়া যায়। এর কারণ হলো পটাশিয়ামসমৃদ্ধ রাসায়নিক সার থেকে অতি দ্রুত পটাশিয়াম লবণাক্ত মাটির সোডিয়ামের বাধাকে অতিক্রম করে গাছের ব্যবহার উপযোগী অবস্থায় আসে। ফলে ফলন বৃদ্ধি পায়।
চাষি ভাইদের আর্থিক দৈন্য এবং কৃষিজমির দুর্বল স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে কৃষি বিজ্ঞানীরা উপকূলীয় লবণাক্ত জমির জন্য ছাই চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কেননা ছাইতে যথেষ্ট পটাশিয়াম রয়েছে। তাই ছাই প্রয়োগে ছাইয়ের পটাশিয়াম লবণাক্ত মাটির সোডিয়ামকে প্রশমিত করে ভারসাম্য তৈরি করে এবং ধানের ফলন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
বোরো মৌসুমে যে জমি লবণাক্ত (৮-৯ ডিস/মিটার) জমি আমন মৌসুমে জলমগ্ন হওয়াতে অলবণাক্ত (২-৩ ডিএস/মিটার) জমিতে পরিণত হয়। বৃষ্টির পানি বা সেচের মাধ্যমে মিষ্টি পানি জমিতে প্রবেশ করাতে পারলে লবণাক্ততা কমে গিয়ে তা স্বাভাবিক জমিতে পরিণত হওয়ায় মাটির সব খাদ্যোপাদানই ধানগাছ তখন সহজে গ্রহণ করতে পারে। তাই শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত সেচ প্রদান করেও লবণাক্ত ধানী জমির সার ব্যবস্থাপনা করা যায়।
আরমান হায়দার

কপিজাতীয় সবজির ঘোড়াপোকা

কপি জাতীয় সবজির ঘোড়াপোকা






কপিজাতীয় সবজিতে বেশ কয়েকটি পোকা আক্রমণ করে। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ঘোড়পোকা। ঘোড়াপোকা মূলত পাতা খায়। ফুলকপি ও বাঁধাকপির পাতা খেয়ে বেশ ক্ষতি করে।
পূর্ণবয়স্ক ঘোড়াপোকার মথ দেখতে ধূসর-বাদামি রঙের। স্ত্রী মথ পোষক গাছের পাতায় একটি করে ডিম পাড়ে। ডিমের পৃষ্ঠদেশ মসৃণ, হালকা সবুজ রঙের এবং সামান্য চ্যাপ্টা। ৩ দিনের মধ্যে ডিম ফুটে কীড়া বের হয়। এরপর কীড়া নিজ দেহের চার দিকে মুখের লালা ব্যবহার করে কোকুন তৈরি করে। কোকুন থেকে ১৩ দিন পর পূর্ণবয়স্ক পোকা বা মথ বের হয়। কীড়া অবস্থা গাছের ক্ষতি করে। কীড়া আগার দিকের পাতা খেয়ে গাছকে প্রায় পাতাশূন্য করে ফেলে। বাঁধাকপি, ফুলকপি, ওলকপি ও ব্রকলি ছাড়াও এরা বিকল্প পোষক হিসেবে বীট, টমেটো, আলু, মটরশুঁটি, লেটুস, সয়াবিন, গো-মটর, চীনা বাদাম, পালংশাক, তুলা এবং কার্নেশন ও ন্যাসটারশিয়াম ফুলের গাছকে ব্যবহার করে এবং এদের পাতা খায়। পাতা দেখতে জালের মতো হয়ে যায়।
ঘোড়াপোকা নিয়ন্ত্রণে নিয়মিত ক্ষেত পরিদর্শন করতে হয় এবং পোকার ডিম বা পোকা দেখা মাত্র হাত দিয়ে সংগ্রহ করে আক্রান্ত পাতাসহ নষ্ট করে ফেলতে হয়। আলোর ফাঁদ ব্যবহার করে মথ মেরে ফেলা যেতে পারে। আক্রান্ত ক্ষেতে ব্যাসিলাস থুরিনজিয়েনসিস ব্যবহার করা যায় , এতে পোকা সাথে সাথে মরে না। পোকার খাবার অরুচি সৃষ্টি করে পোকাকে দুর্বল করে মেরে ফেলে। যখন প্রতি ১০টা গাছে একটা করে পোকা বা পোকার মথ দেখা যায় তখনই ফেনিট্রথিয়ন (সুমিথিয়ন ৫০ ইসি, ফলিথিয়ন ৫০ ইসি ইত্যাদি) অথবা সাইপারমেথ্রিন (রিপকর্ড ১০ ইসি, ম্যাজিক ১০ ইসি, বাসাথ্রিন ১০ ইসি ইত্যাদি) জাতীয় কীটনাশক ব্যবহার করতে হয়।
ক্ষেতের আগাছা নিয়ন্ত্রণ করা, বিশেষ করে বনসরিষা বা বন্য বাঁধাকপি বা কপিজাতীয় আগাছা যেসব গাছে কীড়া সাময়িকভাবে আশ্রয় নিতে পারে। এ পোকা প্রাকৃতিকভাবেই একটি রোগে আক্রান্ত হয়ে প্রথমে হলুদাভ ও পরে ধূসর সাদা রঙের হয়। এই আক্রান্ত পোকা সংগ্রহ করে পানির সাথে মিশিয়ে আক্রান্ত ক্ষেতে স্প্রে করলে অন্য পোকাগুলো আক্রান্ত হয়ে মরে যেতে পারে। কপিজাতীয় চারা রোপণের সময় সঠিক দূরত্ব বজায় রাখতে হয়। তাতে এক গাছ থেকে আরেক গাছে এরা ছড়িয়ে পড়তে পারে না। স্প্রে করার সময় পাতার উপরে ও নিচে ভালোভাবে স্প্রে করতে হয়।
খোন্দকার মেসবাহুল ইসলাম, কৃষিবিদ

রবিবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

পুষ্টিকর ফল সফেদা





বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া যে কোন ধরনের ফল উৎপাদনের জন্য অত্য- উপযোগী। খুব একটা কষ্ট না করেও নানা ধরনের ফল-ফুলের গাছ আমাদের এখানে উৎপাদন করা যেতে পারে। এক সময় বাংলাদেশ বিভিন্ন ধরনের ফল উৎপাদনে ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। সাধারণত বিরল প্রজাতির কিছু ফল ছাড়া কোন ফলই আমাদের দেশে আমদানি করতে হত না। বাংলাদেশে যে সব ফল উৎপাদিত হয় তা গুণগতমানের দিক থেকে অত্য- উন্নত। কিন্তু ফলের উৎপাদন কমে যাবার কারণে বর্তমানে বিদেশ হতে নানা ধরনের ফল আমদানি করে স্থানীয় চাহিদা পূরণ করতে হয়। একজন সুস্থ মানুষকে প্রতিদিন যে পরিমাণ ফল গ্রহণ করতে হয় তা আমাদের পক্ষে যোগান দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। অথচ আমাদের দেশে এমন অনেক ফল রয়েছে যা একটু চেষ্টা করলেই উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বিদেশে রফতানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এমনি একটি সম্ভবনাময় ফল হচ্ছে সফেদা।
বাংলাদেশে যতগুলো মিষ্টি জাতীয় ফল পাওয়া যায় তার মধ্যে সফেদা অন্যতম। সফেদা ফল যে কোন ফলের সাথে তুলনীয়। বাংলাদেশের মাটি ও আবহাওয়া সফেদা উৎপাদনের জন্য খুবই উপযোগী। ফলে দেশের সর্বত্রই সফেদা জন্মাতে পারে। তবে বরিশাল, চট্টগ্রাম, খুলনা প্রভৃতি জেলায় সফেদা ফল বেশি জন্মে। সফেদা ফলে বিভিন্ন ধরনের খনিজ পদার্থ এবং ভিটামিন ‘এ’ ও ভিটামিন ‘সি’ পাওয়া যায়। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনিস্টিটিউট সফেদা ফলের কয়েকটি উন্নতজাত উদ্‌ভাবন করেছে। বাংলাদেশে নানাজাতের সফেদা ফল পাওয়া যেতে পারে। আকারের ভিত্তিতে সফেদা ফলকে দুই শ্রেণীতে বিভক্ত করা যায়। একটি বড় জাতের সফেদা এবং অন্যটি ছোট জাতের সফেদা। বড় আকারের সফেদা ওজনে বেশি বলে তা অর্থনৈতিক বিচারের বেশি গ্রহণীয় কিন্তু স্বাদের দিক দিয়ে ছোট সফেদার কোন তুলনা নেই। সফেদা গাছ বহুবর্ষজীবি একটি গাছ। ফলে একবার একটি গাছ বপন করলে তা হতে বছরের পর বছর ফল পাওয়া যাবে। সফেদা গাছ সাধারণত ৩০/৩২ ফুট পর্য- লম্বা হয়ে থাকে। একই সাথে ফল এবং কাঠ পাওয়া যায় এমন গাছ হচ্ছে সফেদা। বেলে ও বেলে দো-আঁশ মাটিতে সফেদা ফল গাছ ভাল জন্মে। সফেদা ফল গোলাকার এবং কিছুটা লম্বাটে। ফল পরিপক্ক হবার পর তা গাছ থেকে তুলে আনতে হয়। তবে গাছে পাকলে সেই ফলের স্বাদ তুলনামূকভাবে বেশি। সফেদা ফলের সবচেয়ে বড় শত্রু হচ্ছে কাঠবিড়ালি ও বাদুর। তাই ফল পাকার সময় হলে বাদুর এবং কাঠবিড়ালির উপদ্রব বন্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় বেশিরভাগ পাকা ফলই এরা খেয়ে ফেলে।

সফেদা ফলের চারা উৎপাদনের ক্ষেত্রে কলম পদ্ধতিই সবচেয়ে ভাল। বীজ থেকেও গাছ জন্মানো যেতে পারে। তবে বীজ হতে সৃষ্ট গাছে ফল আসতে বিলম্ব হয়। খামার হিসেবে সফেদা চাষ করতে হলে ৬ বাই ৬ মিটার দূরত্বে গাছের চারা লাগানো যেতে পারে। সফেদা গাছ গরম সহ্য করতে পারে বলে গাছে কোন ধরনের পানি সেচ না দিলেও গাছ বেড়ে উঠতে পারে। ভাল ফল পেতে হলে কিছুদিন পর পর হালকা সেচ দেয়া যেতে পারে। এ ছাড়া কিছু সারও প্রয়োগ করা যেতে পারে। সারা বছরই সফেদা গাছে ফল ধরে। তবে সেপ্টেম্বর হতে মার্চ পর্য- সবচেয়ে বেশি ফল পাওয়া যায়। সফেদা ফল বিক্রি হয়। এ ছাড়া সফেদা ফল দিয়ে জ্যাম-জেলি ইত্যাদি তৈরি করা যেতে পারে। প্রতিটি বাড়িতে একটি করে সফেদা ফলের গাছ লাগালে পরিবারের ফলের চাহিদার বিরাট অংশ পূরণ করা সম্ভব।
এম·এ খালেক, ঢাকা

ইলিশের প্রাচুর্য ফিরিয়ে আনতে হবে

ইলিশের প্রাচুর্য ফিরিয়ে আনতে হবে





বাংলাদেশের মানুষ ভোজন বিলাসী। আর এই পরিচয়ে প্রথমেই আসে মাছ এবং ভাতের কথা। অর্থাৎ, মাছে-ভাতে বাঙালি। ভোজনে পটু এই জাতির খাদ্য তালিকায় প্রথম পছন্দের মাছ হল ইলিশ। আবহমান বাংলার নিজস্ব যে পরিচয় তা হচ্ছে সাগর-মোহনা, নদ-নদী, বিল-ঝিল, হাওড়-বাওড়। এদেশের জলরাশির প্রতিটি কণা থেকে সোনার জন্ম হয়। জলে মাছ, জলে ফসল, জলেই দেশের কৃষিক্ষেত্র আজ পলি আচ্ছাদিত উর্বরা শক্তি। আমাদের দেশের জলরাশিতে সারাক্ষণ সূর্যরশ্মি পরে। এই রশ্মির আলোর প্রভাবে জলজ সম্পদ উৎপাদনে পরিপূর্ণ। যেজন্য এখনও জলজ সম্পদে টিকে আছে ৭৫০ প্রজাতির মাছ, ৭০ প্রজাতির চিংড়িসহ অন্যান্য জলজ প্রাণী।
দেশের জাতীয় ও জননন্দিত মাছ হিসেবে ইলিশের সমাদর আদিকাল থেকেই। ইলিশ মাছ মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর কোলোষ্টরল কমাতে সাহায্য করে এবং উপকারী কোলোষ্টরলের পরিমাণ বাড়ায়। ইলিশে খাদ্যের প্রাণীজ আমিষের অবদান শতকরা ৯·৫ ভাগ। এবারে মৎস্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেশে ইলিশের উৎপাদন আমাদের আশার সঞ্চার করেছে। পত্রিকা সূত্রে জানা যায়, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে শতকরা ১১ ভাগ। শুধুমাত্র প্রজনন ক্ষেত্রগুলোতে ডিমওয়ালা মাছ সংরক্ষণ এবং জাটকা মারতে না দেয়াতে এবারের এই অধিক উৎপাদন। দেশের ১৪৩টি উপজেলা এবং ১৪১৯টি ইউনিয়নে প্রায় ৪·৫ লাখ স্থায়ী ও অস্থায়ী জেলে ইলিশ মাছ ধরলেও শুধুমাত্র ডিম ছাড়ার স্থান হিসেবে উপকূলীয় ৭টি জেলার ২০টি উপজেলার ৭ হাজার বর্গ কিঃ মিঃ উপকূলীয় এলাকা। এখানে প্রজনন মৌসুমে প্রজননক্ষম মাছ সংরক্ষণের কারণে এবারে অভূতপূর্ব উৎপাদন এসেছে। পঞ্চাশের দশকে আমাদের দেশে ইলিশের উৎপাদন ছিল ১ থেকে ১·৫ লাখ টন। পরে তা কমলেও ১৯৮০-৮১ সালে সেই উৎপাদন ১ লাখ টনে দাঁড়ায়। যদিও ১৯৮৬-১৯৮৭ সালে উৎপাদন হয় ২·৪২ লাখ টন।

ইলিশ মাছ আমাদের অর্থনীতিতে প্রথম থেকেই তার অবস্থান সুদৃঢ় করে নিয়েছে। ২০০১-০২ সালে ইলিশের উৎপাদন ছিল ২·৩০ লক্ষ টন। দেশের অর্থনীতিতে যার অবদান ছিল শতকরা ১৩ ভাগ। জিডিপি’ তে অবদান ছিল শতকরা ১·২৫ ভাগ। অর্থনীতিতে অবদানের পাশাপাশি মানবদেহের প্রয়োজনে ইলিশের অবদান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, শরীরের পুষ্টি রক্ষা এবং বৃদ্ধির জন্য ইলিশ মাছের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কেননা, প্রতি ১০০ গ্রাম ইলিশ মাছ থেকে পাওয়া যায়- ক্যালসিয়াম ০·১৮ গ্রাম, ফসফরাস ০·২৮ গ্রাম, লৌহ ২১৩ মিঃ গ্রাম। এছাড়া এই মাছের মাংশে খাদ্যউপাদান রয়েছে শতকরা ২·২ ভাগ আঁশ, ৫৩·৭ জল, ১৯·৪ বডি ফ্যাট এবং ২১·৮ প্রোটিন। যেজন্য ইলিশ মাছ স্বাদ ও মুখরোচক খাদ্য হিসেবে বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে বাঙালির কাছে।

ইলিশ মাছ খাদ্যের খোঁজে এবং ডিম ছাড়তে লোনা জল থেকে মিষ্টি জলে আসে। ডিম ছাড়া শেষ হলে আবার ফিরে যায় লোনা জলে। আসা-যাওয়ার সময় ধরা পড়ে জেলেদের জালে। কখনও ইলিশ হয়ে, আবার কখনও জাটকা হিসেবে। এদেশের তাপমাত্রা, কার্বন-ডাই অক্সাইড, পি-এইচ, অক্সিজেন, জলের ক্ষারত্ব, ঘোলাত্ব স্রোত এবং প্রাকৃতিক খাদ্যের জন্য রয়েছে অনুকূল পরিবেশ। সাধারণত সাগরের মোহনা থেকে নদ-নদীর উজানে প্রায় ১৩০০ কিঃ মিঃ পর্য- ইলিশ মাছের বিচরণ ক্ষেত্র। স্থান-কাল ভেদে ইলিশ মাছের আকার যাই হোক না কেন, পুরুষের তুলনায় স্ত্রী ইলিশ মাছের আকার বড় হয়ে থাকে। একটি পরিপক্ক ইলিশ তার পরিণত অবস্থায় ৫ থেকে ২০ লাখ ডিম দিয়ে থাকে। বর্তমানে নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ার জন্য ইলিশের প্রজনন ক্রিয়ায় প্রভাব পড়েছে। সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাসে ইলিশ মাছ ডিম ছেড়ে থাকে। ভোলার ঢলচর, মনপুরা, নোয়াখালী জেলার হাতিয়ার, কালিরচর ও মৌলভীরচরকে ইলিশের প্রজনন এলাকা হিসেবে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়।

২০০৮ সালে আমাদের দেশে ইলিশের উৎপাদন বিগত বছরের তুলনায় শতকরা ১১ ভাগ বেশি হলেও উৎপাদন ও সংরক্ষণের জন্য রয়েছে অনেক প্রতিবন্ধকতা। তার মধ্যে ফারাক্কার মরণ ছোবল, নদীগুলোতে পলি পরে ভরাট, মেঘনা নদীর মোহনার জায়গা বেহাত হয়ে যাওয়া, দেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ এবং জলজ পরিবেশ দূষণের মত সমস্যা উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া আমাদের জেলেদের লোভ ও অজ্ঞতার কারণে হাজার হাজার মেঃ টন জাটকা ধরে ইলিশের বংশ শেষ করে দিচ্ছে। তবে চলতি বছর এই সমস্যার মোকাবিলা করে আশানুরূপ আহরণ করা সম্ভব হয়েছে। এর পেছনে রয়েছে- জাটকা নিধন রোধ করা, ইলিশের আবাসস্থলকে সমুন্নত রেখে উৎপাদন করতে দেশের মৎস্য অধিদপ্তর নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করার ফলে এ বছরে এই সফলতা। জেলেদের বিকল্প আয়-রোজগারের ব্যবস্থা, জাটকা নিধন রোধকল্পে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। এখন শুধু ভৌত এবং অবকাঠামোগত অবস্থার পরিবর্তন এনে ইলিশ রক্ষার নানামুখী পরিকল্পনা হাতে নেয়া দরকার। মাছের উৎপাদন যা-ই বাড়-ক না কেন প্রতি বছর যেভাবে প্রায় ২৫ লাখ মানুষ দেশের মোট জনগোষ্ঠির সাথে যোগ হচ্ছে তাতে এই বাড়তি উৎপাদন মোটেও আশাব্যঞ্জক নয়। ইলিশ মাছকে রক্ষা করতে হলে আমাদের করার আছে অনেক কিছু। নভেম্বর থেকে মে মাস পর্য- সময়ে মৎস্য সংরক্ষণ আইন-১৯৫০ (সংশোধিত) আইনের মাধ্যমে জাটকা ধরা নিষেধ আছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন বাজারে বছরের সব সময়ে জাটকা পাওয়া যায়। এজন্য প্রয়োজন সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন এবং তা কার্যকর করা।

রাজবাড়ি জেলার গোয়ালন্দে পদ্মা-যমুনা নদীর সঙ্গমস্থলে জলের বর্ণ দুধরনের। পদ্মার ঘোলা জল এবং যমুনার স্বচ্ছ জলের মিলনস্থানে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ বিচরণ করে থাকে। এখানে ইলিশের প্রজননক্রিয়া ভাল হয়। এই প্রজনন এলাকাকে সংরক্ষিত করতে হবে যাতে ইলিশের নিরাপদ অভয়াশ্রম হয়। জলদূষণ রোধে কঠোর ব্যবস্থা এবং ইলিশ রক্ষার ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে জাটকা রক্ষায় আইনি প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয়
“আন্ত-সম্পর্কীত দপ্তর” স্থাপন করতে হবে। ইলিশ নির্ভর জেলেদের অবসরকালীন সময়ের জন্য কাজের ব্যবস্থা ও ইলিশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি এই মাছের গুরুত্ব বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এছাড়া ইলিশ বিচরণ জলাশয়গুলোর নাব্যতা তৈরি করতে হবে এবং বর্ষার সময়ে বাড়তি জলের স্টকহোল্ড গড়ে তুলতে হবে। মেঘনার মোহনা দখলমুক্ত রাখতে হবে, তাহলেই ভবিষ্যতে স্বাচ্ছন্দ্যময় এক ইলিশ জোন গড়ে উঠবে।
গৌতম কুমার রায়, কুষ্টিয়া
অয়েল পাম চাষের সম্ভাবনা




নানা সম্ভাবনার দেশ বাংলাদেশ। বিশেষত কৃষিতে এ সম্ভাবনা আরও বেশি। এমনি একটি নতুন সম্ভাবনার নাম অয়েল পাম চাষ। খাদ্য শস্যের নিরাপত্তাহীনতার পাশাপাশি বর্তমানে ভোজ্যতেলের নিরাপত্তাহীনতা দেশের অন্যতম সমস্যা। প্রতি বছর ভোজ্যতেল আমদানি বাবদ আমাদের বর্তমান প্রায় ১৩০ কোটি ইউএস ডলার ব্যয় হয়। অয়েল পাম চাষ করে আমরা সহজেই ভোজ্যতেল আমদানি বাবদ টাকার একটি উল্লেখযোগ্য অংক সাশ্রয় করতে পারি।
বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান ও জলবায়ু অয়েল পাম চাষের জন্য অত্য- উপযোগী। এ দেশের রাঙ্গামাটি, দুদুকছড়ি (খাগড়াছড়ি), কুমিল্লা, মুন্সীগঞ্জ, ফরিদপুর, মাগুরা, ঝিনাইদহ এবং চুয়াডাঙ্গার দক্ষিণাঞ্চলের সব জেলায় অয়েল পাম সন্দেহাতীতভাবে চাষ করা সম্ভব।
দিনাজপুরের হাজী দানেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ১টি, ঘাটাইলের রামজীবনপুরে ২টি এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬৩টি গাছের সবকটিতে ফল আছে।
সুনিষ্কাশিত প্রায় সবধরনের মাটিতে অয়েল পাম চাষ সম্ভব। বাংলাদেশের কক্সবাজার, ময়মনসিংহ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, সিলেট, দিনাজপুর, চট্টগ্রাম, পার্বত্য এলাকাসহ ৩০টি কৃষি জলবায়ু অঞ্চলের মধ্যে ২৭টি কৃষি জলবায়ু অঞ্চলেই অয়েল পাম চাষ সম্ভব। উঁচু ও মধ্যম এবং বন্যার পানি আসে কিন্তু বেশিদিন থাকে না এমন জমিতেও অয়েল পাম চাষ করতে হয়।
পৃথিবীতে জমি ব্যবহারের দক্ষতা এবং উৎপাদন ক্ষমতার দিক দিয়ে সব ধরনের তৈল জাতীয় শস্যের (সয়াবিন, সরিষা, তিল, তিষি, সূর্যমুখী ইত্যাদির) মধ্যে অয়েল পামে চারগুণ বেশি তেল বিদ্যমান। বাংলাদেশের অয়েল পামে শতকরা ৬০ ভাগ পাম অয়েল আছে। অয়েল পাম একটি এনার্জি এফিসিয়েন্ট ফসল। চাষ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণে সার, বালাইনাশক, ফসল জ্বালানির ব্যবহার তুলনামূলক কম হয়। প্রতিহেক্টর জমিতে ৪ টন পাম অয়েল বছরে উৎপাদিত হয় কিন্তু বর্তমানে মালেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়াতে হেক্টরপ্রতি ৭ টন পাম অয়েল উৎপাদনের ক্ষমতাসম্পন্নজাত উদ্‌ভাবিত হয়েছে।
একটি আ-র্জাতিক সমীক্ষায় প্রকাশ, অন্যান্য কৃষি ফসল চাষ করে যেখানে হেক্টরপ্রতি ১২১০ ইউরো আয় হয়, সেখানে অয়েল পাম চাষ করে ১৬১৭ ইউরো আয় করা সম্ভব অর্থাৎ বাংলাদেশে প্রতিহেক্টরে অয়েল পাম চাষ করে বছরে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকার বেশি আয় করা সম্ভব।
অয়েল পাম যেহেতু একটি পাম জাতীয় গাছ তাই অন্য ফসলের সঙ্গে জায়গা, বাতাস, খাদ্য উপাদান সূর্যালোক ইত্যাদির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে না। উঁচু জমির আইল, শিক্ষাদানের পতিত জমি, ক্যান্টনমেন্ট, রা-ার দুপাশ, সংরক্ষিত বনাঞ্চলের পতিত জমি, পাহাড়ি অঞ্চলের পাদভূমির বিশাল এলাকা এ চাষের আওতায় আনা সম্ভব। উপকূলীয় বিশাল এলাকা অয়েল পাম চাষের জন্য প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা যায়।
মালেশিয়া ১৯৬০ সালের পর Land Setlement Scheme এর আওতায় অয়েল পাম চাষ ব্যাপকভাবে শুরু করে। দারিদ্র বিমোচন সফল হয়েছে এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাম অয়েল উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের সেনাপ্রধান ভোজ্যতেলের বিকল্প হিসেবে অয়েল পাম বাণিজ্যিকভিত্তিতে এবং প্রতি বাড়িতে ২/১টি করে চাষ করার পরামর্শ দিয়েছেন। অয়েল পাম সারাবছরই ফল দেয় বিধায় এর উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণের সাথে জড়িত শ্রমিকদের সারা বছরই কর্মে জড়িত থাকার সুযোগ থাকে।
অয়েল পাম গাছ রোপণের তৃতীয় বছর থেকে ২৫ বছর পর্য- লাভজনক ফলন দেয়। যেকোন দেশের দারিদ্র জনগোষ্ঠির জন্য একটি আয়বর্ধক ফসল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভারতের অয়েল পাম চাষকে দারিদ্র বিমোচনের অন্যতম একটি উৎস হিসেবে বিবেচনা করে কাজে লাগানো হয়েছে।
আমি কুমিল্লা সদর উপজেলার মনাগ্রামে ১৬টি অয়েল পামের চারা দিয়ে চাষ শুরু করেছি। আগামী দুবছরের মধ্যে অয়েল পাম চাষ থেকে আমি নিজে যেমন লাভবান হব তেমনি নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে নতুনদের জন্য। বৃহত্তর কুমিল্লাতে আমি একমাত্র পাম চাষের উদ্যোক্তা বললে ভুল বলা হবে না। দিনবদলের এই সরকারের মাননীয় কৃষি মন্ত্রীর সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করছি- এ ব্যাপারে আগ্রহী চাষিদের সব রকম সুযোগ-সুবিধা দেবার জন্য। আমি নিজেই উদ্যোগ গ্রহণ করে কয়েকজন চাষিকে পাম চাষ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। এখন প্রতিদিন আমার কাছে আগ্রহী চাষিরা আসছেন। আমি নিজের হাতে কুমিল্লা প্রসাশকের বাসভবনের সামনে দুটি অয়েল পামের চারা রোপণ করেছি সবাইকে পাম চাষে উদ্বুদ্ধ করার জন্য। এছাড়া আমি কুমিল্লা বার্ড-এ ৩৬টি অয়েল পামের চারা রোপণ করেছি।
বাংলাদেশ সীমান্তে-র সরকারি খাস জমিতে অয়েল পাম চারা রোপণের মাধ্যমে বিডিআর এর সহায়তায় বিশেষ আয়বর্ধক সামাজিক কর্মসূচি হাতে নেয়া যেতে পারে বলে আমি মনে করি।
মনজুর হোসেন, কৃষক, কুমিল্লা

রুহুল আমিনের সাজানো বাগান

রুহুল আমিনের সাজানো বাগান




দিনাজপুরের বিরল উপজেলার দক্ষিণে মহেশ শীবপুর গ্রামের শিক্ষিত যুবক রুহুল আমিন। কৃতিত্বের সাথে ডিগ্রি পাশ করার পর চাকুরির জন্য প্রাণপন চেষ্টা করেও তার ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে পারেননি। হতাশ হয়ে পড়েন তিনি ভবিষ্যৎ নিয়ে। অবশেষে পাশে এসে দাঁড়ান বিরল উপজেলার উপ সহকারি কৃষি কর্মকতা। পরামর্শ দেন, অযথা ঘুরে না বেড়িয়ে কৃষি খামার করা জন্য। সহযোগিতা করেন নানা ধরনের গাছের চারা দিয়ে। রুহুল আমিন নেমে পড়েন খামার তৈরির কাজে। দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে বিরল উপজেলার দক্ষিণে গ্রাম জগতপুর মৌজায় তার খামারের অবস্থান।
বর্তমানে ২২ একর জমিতে তার বাগানে রয়েছে ফজলি আম, ল্যাংড়া আম, সূর্যপুরী, ছাতাপড়া, গোপাল ভোগ, মিছরি ভোগ, ক্ষিরসাপাড়ী, রাণীপছন্দ, আম্রপালী, মালিকা, বারো মাসি, কাঁচা মিঠা, চিনি ফজলি, চোষা বিন্দাবনিসহ ভারতীয় সাত প্রজাতির আম গাছ। এ ছাড়াও রয়েছে- বেদানা, লিচু, চায়না-২, চায়না-৩ লিচু, কাঁঠালী, হাড়িয়া, মোজাফফরী ও বোম্বাই লিচু, লটকন, জামরুল, বেল, কুয়েতি লেবু, শরিফা, ডালিম, নারিকেল, জাম, করমচা, লেবু, পেয়ারা, চায়না পেয়ারা, কাজী পেয়ারা, লাল পাকি-ানী পেয়ারা, দেশি পেয়ারা, আমড়া দেশি ও থাইল্যান্ড, পিচ ফল, এলাচ, দারচিনি ও তেজপাতা। ৪০০টি আপেল কুল, ১০০টি বাউকুল, ৯০টি থাইকুল, দেশি কমলকুল ও গুটিকুল।
বাগানের অক্লা- পরিশ্রম করেন রুহুল আমিন। প্রথমে খুব বেশি আয় না হলও পরবর্তীতে ভাল আয় আসতে শুরু করেছে। চলতি বছরে রুহুর আমিন এই বাগান থেকে ৫ লাখ টাকা আয় করেছেন। আজ এলাকায় তিনি একজন সফল খামারি। তার বাগান আশপাশের গ্রামগুলোতে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। তাকে অনুসরণ করছেন অনেক বেকার যুবক। রুহুল আমিনের এই সাফল্যের পেছনে সার্বিক সহযোগিতা করেছেন বিরল কৃষি বিভাগের কর্মকর্তা ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক।শিক্ষিত বেকারদের বেকারত্ব দূর করতে রুহুল আমিন হতে পারে এক উজ্জ্বল দৃষ্টা-। চাকুরি নামক সোনার হরিণের পেছনে সময় নষ্ট না করে ছোট আকারে একটি খামার করেও বেকারত্ব দূর করা সম্ভব। আর এর নজির রুহুল আমিন নিজেই।

জিনাত রহমান, দিনাজপুর

দেশি মাছ রক্ষার উপায়-৪

দেশি মাছ রক্ষার উপায়-৪



পুকুরে শোল ও টাকি মাছের পোনা উৎপাদন পদ্ধতিঃ আমি আগেই উল্লেখ করেছি- হ্যাচারিতে শোল মাছের পোনা চাপ প্রয়োগ পদ্ধতিতে উৎপাদন খুবই জটিল। অন্যদিকে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে শোল মাছের পোনা উৎপাদন করা খুবই সহজ। আমার অভিজ্ঞতার আলোকে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে শোল মাছের পোনা উৎপাদন পদ্ধতির বর্ণনা করছি-
ডিসেম্বর/জানুয়ারি মাসে পোনা উৎপাদনের জন্য পুকুর প্রথমে ভালভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। তারপর ২০/২৫ দিন এভাবে শুকিয়ে রাখতে হবে। এতে পুকুরের তলায় এক ধরনের ঘাস জন্মে। ঘাস জন্মালে পুকুরে পানি দিয়ে ভরতে হবে। এরপর পানির নীচে এসব ঘাস ধীরে ধীরে বড় হতে থাকবে এবং একসময় এই ঘাসগুলো পানির উপর ভেসে উঠবে। এ সময় কচুরীপানাও দেয়া যেতে পারে পুকুরে। তবে খেয়াল রাখতে হবে কচুরীপানায় যেন পুকুর ভরে না যায়। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, পুকুরে ঘাস হয়ে গেলে কচুরীপানা দেয়ার প্রয়োজন নেই। পুকুরের চারদিকে কমপক্ষে ৫ ফুট উচ্চতায় জাল দিয়ে বেড় দিত হবে। অন্যথায় বর্ষাকালে শোল মাছ লাফিয়ে চলে যাবে। এরপরে পুকুরে শোল টাকি মাছ মজুদ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতি শতাংশে ৪টি শোল ও ১০টি টাকি মাছ মজুদ করা যেতে পারে। মজুদের পর খাদ্য হিসেবে কার্প জাতীয় মাছের ধানীপোনা দেয়া যেতে পারে। এছাড়া ছোট ছোট ব্যাঙ বা ব্যাঙাচি দেয়া যেতে পারে। ছোট ব্যাঙ অনেক সময় লাফিয়ে চলে যেতে পারে। সে জন্য ব্যাঙগুলোকে আধমরা করে দিতে হবে। ব্যাঙাচি দিলে আধমরা করার কোন প্রয়োজন নেই। ব্রুড শোল ও টাকি মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যাঙাচির তুলনা হয় না। এ জন্য ব্যাঙাচির চাষ করা যেতে পারে। ব্যাঙাচি উৎপাদন করাও খুব কঠিন কিছু নয়।
বৈশাখ মাসের প্রথম থেকে শোল ও টাকি মাছ বাচ্চা দিতে (বাইশ) শুরু করে। বাচ্চাগুলো এক ঝাঁকে থাকে। সপ্তাহখানেক বয়সের হলেই ঠেলা জালি দিয়ে বাইশ (পোনার ঝাঁক) ধরে সিস্টার্ণ বা হাউজে নিয়ে যেতে হবে। খাদ্য হিসেবে প্রথম ১/২ দিন কিছুই খেতে চায় না। তারপরে খাবার হিসেবে চিংড়ি শুটকির গুঁড়া ভালভাবে পিষিয়ে দিতে হয়। এভাবে ২/৩ দিনেই খাবারে অভ্যস্থ হয়ে ওঠে। এভাবে ১৫ দিন খাওয়ানোর পর পোনাগুলো প্রায় ২/৩ ইঞ্চি সাইজ হয়। এরপর পোনাগুলোকে চাষের জন্য অবমুক্ত করতে হবে।
শোল ও টাকি মাছের চাষ পদ্ধতিঃ আমাদের দেশে এখনও বাণিজ্যিকভাবে শোল বা টাকি মাছের চাষ পদ্ধতি চালু হয়নি। অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি- শোল মাছ সাধারনত খৈল বা কুড়া দিয়ে বানানো খাবার খায় না। তবে মরা টাটকা মাছ খেতে দিলে এরা খুব খায়। আমাদের দেশে বা-বতার নিরিখে শোল মাছের একক চাষের সম্ভবনা খুবই কম। কারণ এত কাঁচা মাছ বা শুটকির জোগান দেয়া প্রায় অসম্ভব। তবে যেকোন মাছের সাথে মিশ্রভাবে প্রতি ২ শতাংশে ১টি করে শোল মাছ দেয়া যেতে পারে। শোল মাছের চেয়ে পুকুরে টাকি মাছের চাষ করার একটা বিরাট সম্ভাবনা রয়েছে। পরীক্ষায় দেখা গেছে যে, শুটকি মাছের গুঁড়া মিশ্রিত খৈল ও কুড়া দিয়ে বানানো খাবার টাকি মাছ ভাল খায় এবং বেশ মোটাতাজাও হয় যা শোল মাছের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
শোল মাছ আমাদের দেশে এখন প্রায় বিলুপ্ত প্রজাতীর মাছ হয়ে যাচ্ছে। এ মাছটিকে উপরোল্লিখিত পদ্ধতিতে বাচ্চা ফুটিয়ে সরকারি উদ্যোগে মুক্ত জলাশয়ে ছাড়লে একদিকে যেমন এ মাছটির উৎপাদন ব্যাপকভাবে বাড়বে অন্যদিকে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া শোল মাছটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে অনায়াসে। আবার টাকি মাছটিকেও উপরোল্লিখিত পদ্ধতিতে বাচ্চা ফুটিয়ে যেকোন মাছের সাথে শতাংশ প্রতি ১০টি মাছ অনায়াসে চাষ করে এর ব্যাপক উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব।
এ· কে· এম· নূরুল হক, শম্ভুগঞ্জ, ময়মনসিংহ