বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০০৮

মধুমতির চরাঞ্চলে চীনাবাদাম চাষ

মধুমতির চরাঞ্চলে চীনাবাদাম চাষ



আমাদের দেশের অধিকাংশ চরাঞ্চলেই কৃষকরা কোন ফসল চাষ করবেন তা বুঝে উঠতে পারেন না। আবার ঠিকমত ফসল নির্বাচন না করতে পারায় আর্থিক ক্ষতিরও শিকার হন তারা। বন্যার পানি নেমে যাবার পর এসব চরাঞ্চলের জমি অত্য- উর্বর হয়ে যাওয়ায় এখানে উপযুক্ত ফসল চাষ করে কৃষকদের লাভবান হবার সম্ভাবনা অনেক। জলবায়ুজনিত পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য এসব অঞ্চলে ফসল বৈচিত্র আনা দরকার। পাশাপাশি একটি ফসলের সাথে অন্যান্য সাথী ফসলের আবাদও অনেক বেশি লাভজনক হতে পারে। বন্যার পানি নেমে যাবার পর পরই সেখানে মাটিতে যথেষ্ট রস থাকে এমন বেলে দো-আঁশ মাটিকে চীনাবাদাম চাষের জন্য নির্বাচন করতে হবে।

চীনাবাদাম তেল জাতীয় ফসল হলেও বাংলাদেশে আজও তার ব্যবহার সেভাবে চালু হয়নি। তারপরও চীনাবাদামের চাহিদা দিন দিন আমাদের দেশে বেড়েই চলছে। শহরের অলিতে গলিতে এমন কি বিভিন্ন গ্রামেও ছোট ছোট ছেলেরা ঝাঁকাতে করে গলায় ঝুলিয়ে চীনাবাদাম ভাজা বিক্রি করে। মুখোরোচক খাবার হিসেবে চীনাবাদামের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। তাছাড়া চীনাবাদাম থেকে নানা ধরনের উৎপাদিত পণ্যের বাজারে ব্যাপক চাহিদা থাকায় দিন দিন এর চাষ বেড়েই চলেছে।

চীনাবাদাম উৎপাদনের জন্য সুনামগঞ্জ ও নোয়াখালী বিখ্যাত হলেও নড়াইল জেলা একটা বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এ জেলার লোহাগড়া থানার কালনা, চর কালনা, ইতনা, দৌলতপুর, করফা, তেঁতুলিয়ার বি-ীর্ণ মধুমতির চরাঞ্চল বাদাম চাষের জন্য খুবই উপযোগী। কিন্তু এই চরাঞ্চলে চীনাবাদাম চাষের উজ্জ্বল সম্ভবনা থাকা সত্ত্বেও প্রযুক্তিগত সহায়তা, কৃষিঋণ এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার অভাবে সেখানে এই ফসলের জমির পরিমাণ আশানুরূপ বাড়ছে না। বীজ সংকট, বাজারজাতকরণ করা এবং মধ্যসত্ত্বভোগীদের দৌরাত্মে কৃষকরা ন্যায্যমূল্য পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে চীনাবাদাম চাষিরা উৎসাহ হারিয়ে ফেলছে।

মধুমতির চরাঞ্চলে নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে বাদাম চাষ শুরু হয়েছে এবং ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ পর্য- বাদাম চাষের কাজ চলতে থাকবে। কৃষকরা এখন বীজের সমস্যায় পড়ছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বীজ দিয়ে চাহিদা মেটে না। কৃষি উন্নয়ন সংস্থা বাদামের বীজ সরবরাহ করে না। খোলাবাজারে যে বীজ পাওয়া যায় তার মান খুব খারাপ। আগে ভারত থেকে উন্নতমানের বীজ আনা হত, এখন তা বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া গাজীপুরে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্‌ভাবিত ডিজি-১ ও ডিজি-২ উন্নতজাতের বাদাম বীজের সরবরাহ বাজারে নেই। ঝিঙ্গা জাতের (ত্রিদানা) বাদাম বীজ বাজারে প্রায় দুষ্প্রাপ্য। তাই নিম্নমানের বীজ দিয়ে চাষিদের চীনাবাদাম চাষ করতে হয়।

এর ওপর চীনাবাদাম ক্ষেতে দেখা দেয় টিক্কা রোগ (পাতার দাগি রোগ)। ফলে ফলনের ক্ষেত্রে বিপর্যয় ঘটে। রোগ প্রতিরোধে কোন কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ায় ফলনের ক্ষেত্রে তার প্রভাব পড়ে। এলাকায় কর্মরত উপ সহকারি কৃষি কর্মকর্তার এলাকা বড় হওয়ায় সব জায়গা সামাল দিয়ে পারেন না। ফলে অধিকাংশ সময় চরাঞ্চলে কৃষকদের নিজস্ব অভিজ্ঞতার আলোকে প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে চাষাবাদ করতে হয়। আর এ কারণে কোন মৌসুমে এখানে চীনাবাদামের ফলন ভাল হয়, আবার কোন মৌসুমে ফলন বিপর্যয় হয়। এসব কারণে চীনাবাদাম লাগানোর মৌসুমে এখানে বাদামের ফলন বিপর্যয় হয়। গত কয়েক বছরের কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্যে তার প্রমাণ মেলে। অভিজ্ঞ একজন কৃষক বলেন, উন্নতজাতের বীজ ব্যবহার এবং আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করা হলে চরাঞ্চলে বাদামের উৎপাদন অনেক বাড়বে। তখন কৃষকের কাছে চীনাবাদাম অধিক লাভজনক ফসল হিসেবে বিবেচিত হবে।

নদী পাশে থাকার কারণে এইসব চরাঞ্চলে পানি সেচের কোন অভাব হয় না। উপ সহকারি কৃষি কর্মকর্তা এই এলাকাগুলোর কৃষকদের পরামর্শ দিলে তারা বহু উপকৃত হবে।

চীনাবাদাম পরিপক্ক হতে ১৪০ থেকে ১৫০ দিন সময় লাগে। চীনাবাদামের শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগই পরিপক্ক হলেই ফসল তুলতে হয়। ফসল তোলার পর চীনাবাদামের বীজ ভালভাবে রোদে শুকিয়ে আর্দ্রতা ৮ থেকে ১০% এর নীচে নামিয়ে সংরক্ষণ করতে হয়। এই সংরক্ষণ পদ্ধতি আমাদের অধিকাংশ বাদাম চাষিরাই জানে না। কৃষি কর্মকর্তাদের কাছ থেকে তেমন সাহায্যও পায় না এ ব্যাপারে অবগত হতে। এমন অনেক স্থান আছে সেখানে কৃষি কর্মকর্তাদের কৃষক চেনেই না। সবকিছু বিবেচনায় আনতে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
- মোঃ সাহিদুর রহমান, কৃষক, নড়াইল

কোন মন্তব্য নেই: