বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০০৮

মানবকল্যাণে কীটপতঙ্গ


মানবকল্যাণে কীটপতঙ্গ


বিশ্বে বর্তমানে সনাক্তকৃত কীটপতঙ্গের জাতি (জীবিত ও অধুনালুপ্ত) প্রায় ১০ লক্ষ যা সম- প্রাণী জগতের প্রায় ৭৫ শতাংশ এবং এদের শতকরা ৯৯ ভাগেরও বেশি প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মানুষের উপকারে আসে। বাকি কীটপতঙ্গের উপকারিত এখনও মানুষের অজানা।

সারা বিশ্বে মানুষের সংখ্যা ও কীটপতঙ্গের সংখ্যা হিসেব করলে মাথাপিছু কীটপতঙ্গের সংখ্যা হবে প্রায় ৩০ কোটি। কীটপতঙ্গ হতে আমরা সরাসরি যা পাই তা হল- রেশম, মধু, মোম, গালা ইত্যাদি। এছাড়া কীটপতঙ্গ হতে পাওয়া যায় আরাম-আয়েসের জিনিস, বিলাসদ্রব্য, খাবার রঙ, ওষুধ ইত্যাদি। এছাড়াও ফলের পরাগায়ণ, মাটির উর্বরতা সংরক্ষণ, আগাছ দমন, ময়লা পরিষ্কারণ (মৃত প্রাণী বা উদি্‌ভদকে পচিয়ে মাটিতে রূপা-র) প্রাণী ও মাছের খাদ্য, অনিষ্টকারী কীট দমন বা তাদের বংশ নিয়ন্ত্রণ, অস্ত্রপচার, বৈজ্ঞানিক গবেষণায় ইত্যাদি বহুবিধ কাজে কীটপতঙ্গের বিশেষ অবদান আছে । কীট বিজ্ঞানী গোসার্ড এইচ· এ “মানবকল্যাণে কীটপতঙ্গের ভূমিকা” শীর্ষক প্রবন্ধে লিখেছে যে, “যদি উপকারি পোকা ফসল তথা উদি্‌ভদের অনিষ্টকারী পোকার বংশ বৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি না করতো তাহলে পৃথিবীতে মানুষ ৫ থেকে ৬ বছরের মধ্যে বিলীন হয়ে যেত।”

সুতরাং বোঝা যায় যে, মানুষের অি-ত্ব রক্ষার্থে কীটপতঙ্গের বিরাট ভূমিকা আছে।

ধানের ক্ষেতের পোকা জরিপ করে দেখা গেছে যে, শতকরা ১৫ ভাগ কীটপতঙ্গ ফসলের ক্ষতি করে এবং শতকরা ৮৫ ভাগ কীটপতঙ্গ ওই ক্ষতিকারককে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে পরভোজী ও পরবাসী হিসেবে।

একটি দেশের সার্বভেীমত্ব রক্ষার জন্য তিনটি প্রতিরক্ষা বাহিনী থাকে- স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনী। ধানক্ষেতেও তেমনি তিনটি বাহিনী আছে। স্থল বাহিনীর মধ্যে আছে- মাকড়সা, ক্যারাবিট বিটল, পিঁপড়া ইত্যাদি। নৌ-বাহিনীর মধ্যে আছে- বিভিন্ন প্রজাতির ওয়াটার বাগ, মাইক্রোভেলিয়া, ব্যাঙ, মাছ ইত্যাদি। বিমান বাহিনীর মধ্যে আছে- বোলতা, মাছি, লেডিবার্ড বিটল, ফড়িং, পাখি ইত্যাদি।

উদাহরণের সুবিধার জন্য ধানক্ষেতকে বেছে নেয়া হল। অন্যান্য ফসল ক্ষেতে নৌ-বাহিনী না থাকলেও স্থল ও বিমান বাহিনীর কীট আছে ফসলের ক্ষতিকারক কীটপতঙ্গের বংশ নিয়ন্ত্রণের জন্য। অনেক সময় পোকা দেখা মাত্রই কীটনাশক দিয়ে ক্ষতিকারক পোকা মারতে অনেক অনেক বেশি উপকারী পোকা মেরে ফেলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করছি। মনে রাখতে হবে কীটনাশক মৃদু রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহারের আগে ভাবতে হবে।

প্রধান প্রধান কয়েকটি ফসলের উপকারি বা বন্ধু পোকাঃ

টেট্‌রাগনাথা (লম্বামুখী) প্রজাতির মাকড়সাঃ

বৈশিষ্ট্যঃ ১০ থেকে ২৫ মি·মি· লম্বা, লম্বা মুখ, লম্বা পা। বিশ্রামের সময় পাগুলো লম্বাভাবে একই রেখায় থাকে।

অবস্থানঃ গাছের পাতা ও ডাল।

আচরণঃ দিনের বেশির ভাগ সময় বিশ্রাম করে এবং রাতেরবেলায় আংটির মত জাল বুনে শিকার ধরে।

খাদ্যঃ বাদামি গাছ ফড়িং, সাদা পিঠ শোষক পোকা, আঁকাবাঁকা পাতা ফড়িং, পাতা মোড়ানো পোকা এবং এদের ডিম। দিনে গড়ে ২ থেকে ৩টি পোকা এবং ১২ থেকে ১৫টি ডিম খায়।

জীবনকালঃ ১ থেকে ৩ মাস। স্ত্রী মাকড়সা ১০০ থেকে ২০০টি ডিম পাড়ে।

অক্সিওপেস (লিংকস) প্রজাতির মাকড়সাঃ

বৈশিষ্ট্যঃ ৭ থেকে ১০ মি·মি· লম্বা, পায়ে কাঁটা আছে। স্ত্রী মাকড়সার পেটের দু’পাশে আড়াআড়ি দু’জোড়া সাদা দাগ এবং পুরুষ মাকড়সার মাথার দু’পাশে শুড়ের মত দু’টি স্পর্শ যন্ত্র আছে।

অবস্থানঃ শুকনা ও ছায়াযুক্ত স্থান বেশি পছন্দ।

অচরণঃ এরা জাল বুনে না। দ্রুতগামী, ভাল শিকারি।

খাদ্যঃ বাদামি গাছ ফড়িং, সবুজ পাতা ফড়িং, সাদা পিঠ শোষক পোকা, আঁকাবাঁকা পাতা ফড়িং পাতা মোড়ানো, চুঙ্গি ইত্যাদি। মথ জাতীয় পোকা এরা বেশি শিকার করে। দিনে ২ থেকে ৩ মথ খায়।

জীবনকালঃ ৩ থেকে ৫ মাস। স্ত্রী মাকড়সা ২০০ থেকে ৩৫০টি ডিম দেয়।

ফড়িং (ডেমসেল ফ্লাই/ ড্রাগন ফ্লাই)ঃ

বৈশিষ্ট্যঃ প্রায় ৩০ মি·মি· লম্বা, সরু লাল, কমলা, ধূসর নীলাভ কিংবা হালকা হলদে রঙের ফড়িং।

অবস্থানঃ ধানক্ষেত বা ঝোপের নিচের দিকে। শা- ও ধীরগতিতে চলাফেরা করে।

আচরণঃ গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকে। দেহের পেছন দিকে কিছুটা উঁচু এবং মুখ নিচু করে পাতায় বা কাণ্ডে বসে বিশ্রাম নেয়।

খাদ্যঃ বাদামি গাছ ফড়িং। সবুজ পাতা ফড়িং, সাদা পিঠ শোষক পোকা, পাতা মোড়ানোর পোকা ডিম ও বাচ্চা ধরে খায়।

জীবনকালঃ ১০ থেকে ৩০ দিন। স্ত্রী ফড়িং পানিতে ৩০ পি ডিম দেয়।

ড্রাগন ফ্লাইঃ

বৈশিষ্ট্যঃ এরা আকারে ডেমসেল ফ্লাই এর চেয়ে বড়। মাথার দু’পাশে বড় আকারের দু’টি চোখ। বসে থাকলে পাখনা বিমানের মত ছড়িয়ে থাকে।

অবস্থানঃ গাছের উপরের দিকে উড়ে বেড়ায়।

আচরণঃ এরা খুব চঞ্চল এবং দ্রুত উড়ে চলাফেরা করে।

খাদ্যঃ ডেমসেল ফ্লাইয়ের মত।

জীবনকালঃ ডেমসেল ফ্লাইয়ের মতই প্রায়।

পানিতে বসবাসকারী পরভোজী পোকাঃ

ওয়াটার বাগ (মাইক্রোভেলিয়া প্রজাতির)ঃ

বৈশিষ্ট্যঃ ১·৫ মি· মি· লম্বা, কালো চকচকে এই পোকা পা শরীরের সাথে সমভাবে রাখে।

অবস্থানঃ পানির উপরিভাগে, মাঝে মাঝে কাণ্ডের নিচের দিকে পানির কাছাকাছি অবস্থান করে।

আচরণঃ পানির উপরে খুব দ্রুত চলাচল করে। এরা দল বেঁধে শিকার ধরে খায়। এদের পাখনা আছে, এরা আলোতে আকৃষ্ট হয়।

খাদ্যঃ বাদামি গাছ ফড়িং, সবুজ পাতা ফড়িং সদ্য ফোটা মাজরার বাচ্চা দিনে ৭ থেকে ৮টা খেতে পারে।

জীবনকালঃ ১ থেকে ২ মাস, ৪ সপ্তাহ না খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে। স্ত্রী পোকা ২০ থেকে ৩০টি ডিম পাড়ে।

মেসোভেলিয়া প্রজাতির ওয়াটার বাগঃ

বৈশিষ্ট্যঃ ৩ থেকে ৪ মি· মি· লম্বা হালকা সবুজ রঙের পাখনা ও পাখনাবিহীন, ছোটছোট কাঁটাযুক্ত পা, চুষে খাওয়া উপযোগী মুখ।

অবস্থানঃ পানির উপবিভাগ এবং গাছের নিচের অংশে পানির কাছাকাছি। ধানক্ষেতে বেশি দেখা যায় পাখনাবিহীনদের।

আচরণঃ সাধারণত এরা দলবদ্ধভাবে শিকার করে না। একাকী শিকার করে খায়।

খাদ্যঃ সবুজ পাতা ফড়িং। বাদামি মাছ ফড়িং, আঁকাবাঁকা পাতা ফড়িং সাদা পিঠ শোষক পোকা, মাজরা ইত্যাদির কীড়া। অন্যান্য পোকার চেয়ে এদের খোরাক কম।

জীবনকালঃ ৪৫ দিন। স্ত্রীপোকা ২৮টি ডিম পাড়ে।

পানিতে বসবসকারী আরও অনেক পোকা আছে যেমন-ওয়াটার মেগবার, ওয়াটার স্করপিওন, ব্যাক সুইমার, ওয়াটার বোটম্যন, ওয়াটার ক্যাভেঞ্জার, ডাইভিং বিটল ইত্যাদি।

- কৃষিবিদ হাবিবুর রহমান

কোন মন্তব্য নেই: