বুধবার, ৩ ডিসেম্বর, ২০০৮

নদী ও উন্নয়ন


নদী ও উন্নয়ন

নদী আমাদের কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে জড়িত। আমাদের সমগ্র জীবন ব্যবস্থায়, অর্থনীতি, বাণিজ্য, যোগাযোগে অপ্রতিরোধ্য প্রভাব থাকা সত্ত্বেও উন্নয়ন নদীকেন্দ্রিক হয়নি। অনেক ড়্গেত্রেই নদীবিমুখ হয়েছে। উন্নয়ন চিন্তôায় আমরা ক্রমে ক্রমে নদী ও প্রকৃতি, ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, মানুষের চাহিদা থেকে সরে ভিন্নমুখী একটি শিকড়হীন উন্নয়ন পরিকল্পনায় সময়ড়্গেপণ করছি।পঞ্চাশের দশকে কলম্বো পস্ন্যানের মাধ্যমে উন্নয়নের মডেল উপস্থাপন করা হয়। উন্নয়ন হয়ে ওঠে শিল্পায়ন, শহরায়নের সমার্থক। উন্নয়নের হাওয়া এসে লাগলো অনুন্নত এই জাতিকে উন্নত করতে এবং পশ্চিমাকরণই ছিল প্রকৃত উদ্দেশ্য। সেই সূত্রকেই ধবন্তôরী বলে অন্ধভাবে মেনে নেয়া হয়। শিল্পায়ন ও শহরায়নের প্রবল ধাক্কায় উন্নয়ন শহরমুখী এবং রাতারাতি শিল্প স্থাপন কেন্দ্রিক হয়ে পড়লো। উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু গ্রাম, চালিকাশক্তির মূলভিত্তি কৃষি সেইসঙ্গে নদী ও নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগ ব্যবস্থা। কিন্তু এসব উন্নয়ন তালিকা থেকে ছিটকে পড়লো। শিল্প স্থাপন, শহরায়ন এবং প্রযুক্তিগত অপরিকল্পিত উন্নয়ন বোঝায় পরিণত হয়। কথিত উন্নয়ন পরিকল্পনা ধ্বংস করে দিলো নিজস্ব ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, স্থানীয় শিল্প। আমাদের ধ্যান-ধারণায় যে বিষয়গুলো প্রবলভাবে উপস্থিত সেগুলো একেবারেই বিস্মৃত হয়ে গেল।উপেড়্গা করা হল হাজার বছরের নৌ-যোগাযোগকে। উন্নয়ন পরিকল্পনায় প্রধান হয়ে উঠলো সড়ক যোগাযোগ। প্রয়োজন-অপ্রয়োজনে তৈরি করা হলো ব্রিজ-কালভার্ট। নদীর স্বাভাবিক গতি, সহজভাবে নৌ-চলাচল, নদীকে বাঁচিয়ে রেখে সড়ক যোগাযোগের পরিকল্পনা না করায় নদীগুলোর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ বাধাগ্রস্তô হয়। ফলে নদীগুলো ভরাট হয়ে যায়। নদী শাসন, নদী সংরড়্গণ, নদী উন্নয়নের কোনোকিছুতেই না গিয়ে নদী হত্যা করা হলো।ষাটের দশকে অধিক ‘খাদ্য উৎপাদন’ আন্দোলনের অংশ হিসেবে অনেক স্থানে তৈরি করা হয় বাঁধ, পোল্ডার ও এমব্যাংকমেন্ট। অবকাঠামো নির্মাণের প্রথম এক দশকে অধিক ফসল উৎপাদন হলেও দশক যেতে না যেতে প্রকল্পভুক্ত এলাকায় তৈরি হতে থাকে জলবদ্ধতা।ষাটের দশকে অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাÐের নমুনা উপকূলীয় বাঁধ প্রকল্প (কোস্টাল এমব্যাংকমেন্ট প্রজেক্ট সংড়্গেপে সিইপি)। প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয় ২ হাজার মাইল বেড়িবাঁধ, ৯২টি পোল্ডার ও ৭৮০টি সস্নুইস গেট। দড়্গিণ-পশ্চিম উপকূলীয় এলাকায় এসব স্থাপনা মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। এসব প্রকল্পে দড়্গিণ-পশ্চিমাঞ্চলে এলাকার পরিবেশ ও নদীগুলোর অবস্থানকে গুরম্নত্ব দেয়া হয়নি। পোল্ডার নির্মাণের আগে জনগণের যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম ছিল নৌপথ আর বাহন ছিল নৌকা। কিন্তু পোল্ডার নির্মাণের ফলে কাঁচা বেড়িবাঁধগুলোই হাঁটা রাস্তôা হিসেবে ব্যবহৃত হতে থাকে। পরে অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ হতে থাকে রাস্তôা-কালভার্ট। ফলে নদী যেমন শুকিয়ে গেছে তেমনি শুরম্ন হয়েছে জলাবদ্ধতা। এই অঞ্চলের ১২টি নদীর মধ্যে ২টি কোনোমতে টিকে আছে। বাকি নদীগুলো শীর্ণ খালে পরিণত হয়েছে। শীতকালে নদীগুলোকে চেনাই মুশকিল। শ্রীহরি, মুক্তেশ্বরী, ভদ্রা, আপার ভদ্রা, কপোতাড়্গ, চিত্রা, ভৈরব, টেকা, ভবদহ, বেত্রাবতী, হামকুড়াসহ বেশিরভাগ নদী এখন ধুঁ ধুঁ মাঠ বা শীর্ণ খালের দশা পেয়েছে। আংশিক টিকে থাকা ভৈরব ও কপোতাড়্গ নদীর তলদেশ যেভাবে ভরাট হচ্ছে তাতে আগামী দুই-এক বছরের মধ্যে এ দুটি নদীও পুরোপুরি শুকিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা রয়েছে।জলবায়ু পরিবর্তন ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাÐে দেশের বেশিরভাগ নদীই হারিয়ে যাচ্ছে। পলি জমে মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে ১৭টি নদী। আরো ৮টি নদী অল্প সময়ের মধ্যে মরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সাম্প্রতিক জরিপে জানা গেছে, গত কয়েক বছরে দেশের ১৭টি নদী পুরোপুরি মরে গেছে। এগুলোর মধ্যে বেশিরভাগ দেশের উত্তর ও দড়্গিণাঞ্চলের। খরস্রোতা নদীগুলো এখন তাদের কঙ্কাল বয়ে চলছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের সূত্রে, মৃত নদীগুলো হচ্ছে- কিশোরগঞ্জের নরসুন্দা, রাজবাড়ী-ফরিদপুরের ভুবনেশ্বর, হবিগঞ্জের বিবিয়ানা ও শাখা বরাক, শরীয়তপুরের পালঅং, কুমিলস্না ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বুড়ি নদী, যশোরের হরিহর ও মুক্তেশ্বরী, খুলনার হামকুড়া, সাতড়্গীরার মরিচাপ, লক্ষ্মীপুর ও নোয়াখালীর বামনী, বগুড়ার মানস, নাটোর-পাবনার বড়াল ও চিকনি, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, যশোর, খুলনা, বাগেরহাটের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ভৈরব।পানি উন্নয়ন বোর্ডের তালিকায় দেশের আরো ৮টি নদী মরে যাওয়ার পথে। এগুলো হচ্ছে- পঞ্চগড়, নীলফামারী, রংপুর, বগুড়া ও সিরাজগঞ্জের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া করতোয়া, পাবনা, মানিকগঞ্জ, ঢাকা, মুন্সীগঞ্জের ইছামতি, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, মাগুরা, নড়াইল, পিরোজপুরের কালিগঙ্গা, কুষ্টিয়া, মাগুরা, ফরিদপুর, ঝিনাইদহ, মাদারীপুরের কুমার, নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহের চিত্রা, যশোর ও খুলনার ভদ্রা, নেত্রকোনার সোমেশ্বরী এবং নড়াইলের নবগঙ্গা।সভ্যতার বিকাশ ও উন্নয়নের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। যোগাযোগহীন উন্নয়ন দুরূহ বিষয়। যোগাযোগের উন্নয়ন মানে অন্য একটি মাধ্যমের সম্ভাবনাকে নষ্ট করা নয়। নৌ, রেল ও সড়ক যোগাযোগের মাধ্যমে কীভাবে একটি সমন্বিত যোগাযোগ গড়ে তোলা যায়, কীভাবে মাধ্যমগুলো ব্যবহারে সর্বোচ্চ সুফল পাওয়া যায় তা আমাদের উন্নয়ন কৌশল স্থান লাভ করেনি। উন্নয়ন তাই পরবর্তী সময়ে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে এবং সুফলতার পরিবর্তে নতুন সমস্যার জন্ম দিয়েছে। উন্নয়নের জোয়ারে ভেসে গিয়েও দেখা গেছে শুধু ভাটার টান।

কোন মন্তব্য নেই: