বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর, ২০০৮

নির্বাচন ২০০৮: কি আছে কৃষি ও কৃষকের ভাগ্যে


নির্বাচন ২০০৮: কি আছে কৃষি ও কৃষকের ভাগ্যে



১৫ কোটি মানুষের বাংলাদেশে কৃষিই এখনও পর্য- উন্নয়ন ও অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। স্বাধীনতার পরবর্তী সময়কালে আশির দশকের মাঝামাঝি পর্য- কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় একধরণের গতি লক্ষ্যণীয় ছিল। অবশ্য সেই গতির পেছনে ষাটের দশকের শেষভাগের সবুজ বিপ্ল্লবের যেমন একটি ধারাবাহিকতা ছিল তেমনি সদ্য স্বাধীন একটি দেশের স্বনির্ভরতা অর্জনের জন্য রাষ্ট্রের ভূমিকাও কম ছিল না। কিন্তু আে- আে- সেই গতিতে বড় ধরণের এক ভাটা চলে আসে। বৈশ্বিক পট পরিবর্তনের পথ ধরে মুক্তবাজার অর্থনীতির বিকাশে বিরামহীন শিল্পায়ন আর নগরায়নের ফলে গ্রামীণ কৃষিজীবি মানুষ তথা কৃষির ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নেয় রাষ্ট্র। ফলে রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য হারিয়ে কৃষি উন্নয়নে স্থবিরতা চলে আসে। ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য চাহিদা পূরণে খাদ্যশস্যের সামগ্রিক উৎপাদন হয়তো এসময় বৃদ্ধি পায় কিন্তু জন্ম নেয় রাসায়নিক উপকরণনির্ভর কৃষি ব্যবস্থা। ফলে উৎপাদন বৃদ্ধি সত্ত্বেও কৃষি উপকরণের জ্যামিতিক মূল্যবৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় কৃষক ধীরে ধীরে দরিদ্র থেকে অতিদরিদ্রে পরিণত হয়। পাশাপাশি অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থায় দ্রব্যমূল্য বাড়লেও তাতে শুধু ফরিয়াদের পকেট ভারী হতে থাকে, উৎপাদিত পণ্যের মূল্যপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে কৃষকের ভাগ্যে জোটে বঞ্চনা, বাড়তে থাকে কৃষি উপকরণের মূল্য; একই সাথে তা হয়ে ওঠে দুষ্প্রাপ্য। এরকম নানাবিধ সংকটে কৃষিতে সৃষ্টি হয় একধরণের সংকট, খাদ্য নিরাপত্তার ইস্যুটিতে আমাদের অবস্থান হয়ে ওঠে ভঙ্গুর, যা প্রকট হয়ে দেখা দেয় ২০০৭ ও ২০০৮-এ পরপর দু’টি বন্যা এবং প্রলয়ংকারী সিডরের পর। টনক নড়ে সবার, সরকারি উদ্যোগ আর কৃষকদের দৃঢ় মানসিকতায় তখন সে সংকট কাটিয়ে ওঠা গেলেও নীতি নির্ধারকদের কপালে চি-ার রেখা দেখা দেয় আগামীর খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে রাষ্ট্রের উদ্যোগ আর কৃষকের আপ্রাণ চেষ্টায় গেল রোরো আর আমন মৌসুমে বাম্পার ফলনে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়। কিন্তু এই সফলতার পরও কৃষির ওপর নেমে আসে আরেক বড় আঘাত। আ-র্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও সারের মূল্য ব্যাপক আকারে বেড়ে গেলে আমাদের দেশেও তার প্রভাব পড়ে। ইউরিয়া ও অন্যান্য সারের মূল্য দ্বিগুণ থেকে শুরু করে কয়েকগুণ পর্য- বেড়ে যায়। সাথে অন্যান্য উপকরণ মূল্যও চলে যায় কৃষকের নাগালের বাইরে। যা আবারও কৃষকদের মাঝে সৃষ্টি করে হতাশা। এ অবস্থায় সময় এসেছে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের। সামনেই জাতীয় নির্বাচন। নির্বাচনী আমেজে সারাদেশেই চলছে ব্যাপক প্রচার প্রচারণা। বিভিন্ন দল থেকেই দেয়া হচ্ছে উন্নয়নের নানা অঙ্গীকার। সেখানে আমরা দেখেছি কৃষি নিয়ে নানা কথা। কৃষির প্রত্যেকটি বিষয়ই তাত্ত্বিকভাবে উঠে এসেছে তাদের সেই ইশতেহারগুলোতে।

কিন্তু এ তো শুধুই অঙ্গীকার যা অতীতেও দেখে এসেছে এদেশের জনসাধারণ। সেগুলোতে এতদিনের বঞ্চিত কৃষিজীবি মানুষগুলোর ভরসা কতটুকু? নানা সময়ে তৃণমূল কৃষকদের সাথে কথা বলতে গিয়ে দেখা গেছে রাজনীতিবিদদের এই অঙ্গীকারে তাদের আর কোন ভরসা নেই। কৃষকদের জন্য কিছু করার আশ্বাস দিয়ে পরে তাদের বঞ্চনার মধ্যে ফেলে দেয়ার ইতিহাস এদেশে এতই বেশি যে কৃষকরা স্বপ্ন দেখতেও এখন ভয় পায়। বঞ্চনার এই উত্তাপ লেগেছে কৃষকের অ-ঃপুরেও। সরকার কিংবা সরকারি তৎপরতায় ক্ষোভ ঝরে পড়ে কৃষাণীদের কণ্ঠেও।

স্বাভাবিকভাবেই ইশতেহারনামার তাত্ত্বিক কথাবার্তায় কৃষকদের এখন আর মন ভরে না। এখন তারা মাঠে এর প্রতিফলন দেখতে চায়। কোন সরকার ক্ষমতায় গেল তা নিয়ে তাদের কোন ভাবনা নেই। তারা স্বল্পমূল্যে এবং সময়মত সার, বীজ কীটনাশকসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণ পেলেই খুশি। সারের জন্য দীর্ঘ লাইন দিয়েও প্রয়োজনের তুলনায় নামমাত্র সার পেয়ে ফসলের ঝলসে যাওয়া আর দেখতে চায় না তারা। গরীব কৃষকরা চায় সহজে এবং সহজ শর্তে ঋণ। ভূমিহীন বর্গাচাষিরা কোন সহায়সম্বল না থাকার কারণে ঋণ থেকে বঞ্চিত হতে চায় না। ঋণ আনতে গিয়ে হয়রানি আর উৎকোচ থেকেও মুক্তি চায় তারা।

কৃষির সেই চিরাচরিত চিত্র আর নেই। কৃষিতে শুধু অশিক্ষিত দুর্বল মানুষ শ্রম দেবে, পাল্টে গেছে এমন ধারণা। এখন অনেক শিক্ষিত মানুষও তাদের মেধা আর অর্থ বিনিয়োগ করছে কৃষিতে। তাদের কথায় উঠে আসছে আগামীর সরকারের কাছে কৃষির চাওয়া। তারা একই সাথে সার-বীজ-কীটনাশকের স্বল্পমূল্য এবং সুলভ প্রাপ্তি যেমন দাবি করছেন তেমনি বলছেন জলবায়ুগত পরিবর্তনে নতুন কৃষি ব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তাও উপলব্ধি করছেন। তারা বলছেন কৃষি বিভাগকে ঢেলে সাজানোর কথা। আসছে কৃষক এবং কৃষি সম্প্রসারণকর্মীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণের কথা। সামগ্রিক বিবেচনায় দেখা যায় কৃষি কিংবা কৃষির উন্নয়ন নিয়ে শুধুমাত্র কৃষিবিদ বা নীতিনির্ধারকরাই ভাবছেন না, কৃষকদের নিজেদের উপলব্ধিও গুরুত্বের দাবী রাখে সমানভাবে। বিষয়গুলো এখন অনেকটাই স্পষ্ট।

কৃষিপ্রধান এই দেশে কৃষিকে বাদ দিয়ে উন্নয়নের যে কোন চি-াই অলীক স্বপ্ন মাত্র। অতীতে একথা প্রমাণিত হয়েছে বারংবার। এতদিনের উন্নয়ন পরিকল্পনায় কৃষি ও কৃষককে যে উপেক্ষা করা হয়েছে তা যেমন সত্য, সেসব পরিকল্পনার বা-বায়নে কতটুকু উন্নয়ন এদেশে হয়েছে তাও রয়ে গেছে প্রশ্নসাপেক্ষ। তাই একথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না যে কৃষিই এদেশের উন্নয়নের প্রধান নিয়ামক এবং কৃষিকে বাদ দিয়ে উন্নয়নের যে কোন পরিকল্পনাই অসম্পূর্ণ এবং নিষ্ফল থেকে যাবে। তাই সামগ্রিকভাবে দেশের যথার্থ উন্নয়নে কৃষিকে মূল শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা এখন সময়ের দাবি মাত্র। সার্বিক ক্ষেত্রে স্ব-নির্ভর একটি জাতি গঠনে কৃষিকে দিতে হবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব আর কৃষককে দিতে তার প্রাপ্য অধিকার ও সম্মান। ইংরেজির নতুন বছরে আগামীর নির্বাচিত সরকার এ প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করে সেদিকেই চোখ থাকবে পুরো জাতির। সবাইকে নতুন বছরের আগাম শুভেচ্ছা।
- শাইখ সিরাজ

কোন মন্তব্য নেই: