রবিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০০৯

জীব-প্রযুক্তিঃ এক ‘অদৃশ্য’ বিপ্লবের নাম


জীব-প্রযুক্তিঃ এক ‘অদৃশ্য’ বিপ্লবের নাম


প্রত্যেকটি সাধারণ কাজের পেছনে থাকে অসাধারণ কোন কিছু। ভাবতেই অবাক লাগে, ভিটামিন এখন একটি সাধারণ পিলের ভেতর চলে এসেছে। হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে যখন পেঁপে ফসলে মারাত্মক ধ্বস নামলো ভাইরাল ডিজিস্‌ এর কারণে, তখন তার সাথে লড়তে হাজির হয়েছিল জীব-প্রযুক্তি। আমরা কি জানি যে বায়োটেক এনজাইম জিন্স প্যান্টের স্টোন-ওয়াশ লুক বা এ্যাপিয়্যারেন্স তৈরিতে সক্ষম? আরও মজার তথ্য হল, বায়োটেক ডিটারজেন্ট পাউডার ওয়াশিং মেশিনে মাত্র ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে কাপড় ধুতে পারছে। এর মাধ্যমে এনার্জি রক্ষা হচ্ছে ব্যাপকভাবে। বিভিন্ন ধরণের গাছপালাকে পরিণত করা যাচ্ছে বায়োপ্লাষ্টিক-এ। একটি গাড়ি পুরো শতভাগ ইথানলের ওপর চলতে পারে। এই জৈব-জ্বালানি এমনকি চিনি থেকেও তৈরি হতে পারে। টিস্যু কালচারের মাধ্যমে উৎপাদিত রঙ-বেরঙের ফুল শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন জায়গায়। আমরা কি জানি আমরা যে টাকাটি ব্যবহার করি তা অংশত তুলার মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে? বিশ্বের কোথাও না কোথাও বায়োটেক গল্পের চল রয়েছে। রয়েছে এর সাথে মানুষের সম্পৃক্ততা। খোদ ইউরোপেই ২০০০ এর বেশি সংখ্যক কোম্পানি রয়েছে যারা জীব-প্রযুক্তি উদ্‌ভাবিত পণ্যের সাথে কাজ করছে। আসছে নতুন নতুন সব সমাধানের দিক-নির্দেশনা। পরিবেশগত দিক থেকেও জীব-প্রযুক্তি যথেষ্ট নিরাপদ। জীব-প্রযুক্তি ব্যবহারের কারণে মানুষের জীবন-জীবিকায় আমূল পরিবর্তন আনতে হচ্ছে না। শুধুমাত্র খাপ খাওয়ানোর বিষয়টির দিকেই খেয়াল রাখতে হচ্ছে। এই অদৃশ্য বিপ্লবই সব মানুষের পাশে সহায়তার হাত বাড়িয়েছে। আজ তাই জীব-প্রযুক্তি সত্যি সময়োপযোগী এক উদ্‌ভাবনের নাম!

সংক্ষেপে কিছু পয়েন্টঃ
১· জীববিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই যে প্রযুক্তি তার নাম ‘জীব-প্রযুক্তি’। বিশেষ করে যখন এই প্রযুক্তি প্রয়োগ হয় কৃষি, খাদ্য, বিজ্ঞান এবং ওষুধের ওপর।

২· বায়ো-টেকনোলজিকে প্রায়ই তুলনা করা হয় জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর সাথে।

৩· ১৯৭১ সালের পূর্বে জীব-প্রযুক্তি টার্মটি মূলত ব্যবহারই হত বিশেষত কৃষি-শিল্পের নানা পণ্যের খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণের সাথে। এছাড়াও বায়োটেকনোলজির সাথে অন্যান্য ধারার রয়েছে সমন্বয়, যেমন- জেনেটিকস, মলিকিউলার বায়োলজি, বায়োকেমেষ্ট্রি, এমব্রাইওলজি এবং সেল বায়োলজি। এই ধারাগুলোর আবার সংযোগ রয়েছে অন্য সরাসরি কিছু ধারার সাথে; যেমন- কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ইনফরমেশন টেকনোলজি এবং রোবোটিকস এর সাথে।

৪· আধুনিক জীব-প্রযুক্তির শুরুটা বলা যেতে পারে ১৯৮০ সালের ১৬ জুন থেকে যদিও বলা হয় নিওলিথিক যুগ থেকেই জীব-প্রযুক্তির প্রচলন ছিল। আনন্দ চক্রবর্তী উদ্‌ভাবন করেন একটি বিশেষ ধরণের ব্যাকটেরিয়াম যা অশোধিত তেল ভাঙতে সক্ষম।

৫· ২০০৮ সালে বায়োটেকনোলজির মাধ্যমে অর্জিত রাজস্ব সারা বিশ্বে বেড়েছে ১২·৯%। এর পেছনে বিশেষ ভূমিকা রয়েছে মেডিক্যাল এবং ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যের উত্তরোত্তর চাহিদা বৃদ্ধি।

৬· জৈব-জ্বালানির চাহিদা বৃদ্ধি জীব-প্রযুক্তি সেক্টরের জন্য একটি দারুণ সুখবর। ইথানল ব্যবহারের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে পেট্রোলিয়াম থেকে প্রাপ্ত জ্বালানির ব্যবহার ৩০% কমে যাবে ২০৩০ সালের মধ্যে।

৭· এছাড়াও উল্লেখ করতেই হচ্ছে জেনেটিক্যালি মোডিফাইড ক্রপস্‌ এর কথা। যেগুলো বিভিন্ন প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতার ক্ষেত্রেও উৎপাদনশীল এবং বিরূপ পরিবেশ সহনশীল। ভুট্টা এবং সয়াবিনের কথা এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এই দুটি শস্যের অবদান একটি বিরাট অংশে ভূমিকা রাখছে জৈব-জ্বালানি উৎপাদনে- এ কথা এখন শিরোধার্য।

৮· ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিস ফর দি এ্যাকুজিশন অফ এ্যাগ্রি-বায়োটেক ক্রপস এর একটি রিপোর্ট বলছে যে, গত এক যুগে বায়োটেক ফসল উৎপাদন বেড়েছে। বেড়েছে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। অতি-দরিদ্র এবং লড়াকু কৃষক তাদের উপার্জন বাড়িয়েছে অনেক কম খরচে।

রিপোর্টটি ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০০৮ তারিখে আইএসএএএ প্রকাশ করে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ যা এই রিপোর্টটির সার-সংক্ষেপ, তা হল কম খরচে বেশি ফসল উৎপাদন। যা দারিদ্র্য নিরসনে সহায়ক হবে। উপার্জন বাড়বে কৃষকের।

৯· জীব-প্রযুক্তির ব্যবহার মূলত চারটি ক্ষেত্রে প্রযোজ্যঃ (ক) স্বাস্থ্য সেবা (মেডিক্যাল), (খ) ফসল উৎপাদন ও কৃষি, (গ) ফসলের শিল্পভিত্তিক ব্যবহার (ভেজেটেবল অয়েল এবং জৈব-জ্বালানি) এবং আর একটি ক্ষেত্র হল (ঘ) পরিবেশভিত্তিক ব্যবহার।

১০· মেডিসিন-এর ক্ষেত্রে আধুনিক জীব-প্রযুক্তির ব্যবহার যেসব জায়গায় হয়ে থাকে তা হলঃ (ক) ড্রাগ উৎপাদন, (খ) ফার্মাকোজেনোমিকস, (গ) জিন থেরাপি এবং (ঘ) জেনেটিক টেষ্টিং। (১০) এছাড়াও, চিকিৎসা বিজ্ঞানের নতুন থেরাপির ক্ষেত্রে জীব-প্রযুক্তি রাখতে পেরেছে অনবদ্য ভূমিকা। এর ভেতর হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, ক্যান্সার, আর্থরাইটিস, হেমোফিলিয়া, বোন-ফ্র্যাকচার, নানাবিধ স্ক্লেরোসিস এবং কার্ডিওভাসক্যুলার অনিয়ম নিরসনে জীব-প্রযুক্তির ভূমিকা অনস্বীকার্য।


বিশ্বের সর্ববৃহৎ বায়োটেক বিস্ফোরণটি ঘটেছিল ২০০০ সালের জুন মাসে- যে দিন বিজ্ঞানীরা ঘোষণা করেছিলেন যে তাঁরা প্রায় শেষ করে ফেলেছেন মানব জিনোম সিকোয়েন্সিং এর কাজ। অর্থাৎ, সৃষ্টির অজানা রহস্য জানতে শুরু করেছে মানুষ। অনেকেই বিজ্ঞানীদের এই সাফল্যকে মানুষের চাঁদের পর্দাপনের চেয়েও বড় ঘটনা বলে অভিহিত করেছেন। কারণ এই জিনোম শুধু বর্তমানকেই নয়, প্রভাবিত করবে মানবজাতির ভবিষ্যতকেও।


তৌফিক আহমেদ

কোন মন্তব্য নেই: