রবিবার, ৪ জানুয়ারী, ২০০৯

হারিয়ে যাচ্ছে দেশি গাছ


হারিয়ে যাচ্ছে দেশি গাছ


অমিত সম্ভাবনার এই দেশ, বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক সম্পদে পরিপূর্ণ। প্রকৃতিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বনজ-ভেষজ-ঔষধি ও নিত্য প্রয়োজনীয় গাছপালা। এদের অনেকগুলোই আছে ঔষধি ও ভেষজ গুণাগুণ, অপরদিকে রয়েছে ভিটামিন ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধতা। কিন্তু অব্যাহতভাবে গাছ কেটে ফেলায় প্রাকৃতিক বন, একই সাথে দেশিয় প্রজাতি এবং ভেষজ ও ঔষধি জাতের গাছ-গাছালি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে দিন দিন। নতুন করে বনায়নে ‘ইউক্যালিপটার্স’ ‘আকাশিয়া’ সহ আগ্রাসী প্রজাতির বিদেশি গাছ স্থান দখল করছে। এতে বন, বন্যপ্রাণী ও পরিবেশের ক্ষতিছাড়াও ঔষধি গাছগাছড়া থেকে রাজস্ব আয় বঞ্চিত হচ্ছে সরকার।
দেশে বৃক্ষ নিধন, কাঠ পাচার যেমন একটি ভয়াল সমস্যা তেমনি জটিল সমস্যা ঘুরপাক খাচ্ছে বনায়নের জন্য গাছ লাগানোকে কেন্দ্র করে। বনায়ন কর্মসূচি হাতে নিলেই কোন কাজ হবে না। কোথায় কী ধরণের গাছ লাগাতে হবে সে পরামর্শও দিতে হবে বনায়ন কর্মসূচি থেকে।
২০০১ সালের মার্চে ঢাকা মহানগরে এনজিও ফোরাম আয়োজিত এক সেমিনারে একজন পরিবেশ বিজ্ঞানী ইউক্যালিপটাস, আকাশিয়া ইত্যাদি গাছকে ‘সন্ত্রাসী’ গাছ হিসেবে চিহ্নিত করেছিলেন। এছাড়াও ‘গ্রীণফোরাম’ কর্তৃক আয়োজিত একটি সেমিনারে ‘আগ্রাসী প্রজাতির বিদেশি গাছ দিয়ে বনায়ন করা হচ্ছে’ এই প্রবন্ধে বলা হয়েছে ইউক্যালিপটাস, পাইন, আকাশিয়া ইত্যাদি গাছ লাগিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে কৃত্রিম বনায়ন করা হচ্ছে যা পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ। এ অবস্থায় কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে দেশিয় প্রজাতির গাছগাছালি। আগেকার দিনে গ্রামগঞ্জে ভেষজ গুণাবলীসম্পন্ন প্রচুর লতাগুল্ম দেখা যেত, এখন কিন্তু তেমন একটা দেখা যায় না। দেশের বিভিন্ন এলাকার নার্সারিসমূহ থেকে জানা গেছে বর্তমানে দেশিয় প্রজাতির বৃক্ষ এবং ভেষজ গাছগাছালির খুবই কম চাহিদা রয়েছে।
যেসব গাছপালা বিলুপ্তির আশংকাযুক্ত অবস্থায় রয়েছে তাদের মধ্যে শ্রেণী বিভাগ রয়েছে। কোনটা হয়তো হারিয়ে গেছে, আবার কোনটা হয়তো শুধু বনে হারিয়ে গেছে, কিন্তু হয়তো চাষাবাদে রয়েছে। প্রাকৃতিক বনে বিদেশি গাছ লাগানো হচ্ছে। কিন্তু পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে এগুলো ক্ষতিকর। বিদেশি গাছ বন্য প্রাণীর জন্য হুমকিস্বরূপ। যেমন ইউক্যালিপটাস, আকাশমনি গাছ। ইউক্যালিপটাস গাছ মাটির ক্ষতি করে। রোগবালাই তৈরি করে। বাংলাদেশ বন গবেষণা ইন্সিটিটিউট এর পরিচালকের বক্তব্যে (অক্টোবর-০২) বলা হয়ে থাকে, ইউক্যালিপটাস জমির জন্য ক্ষতিকর, তাই এই গাছ লাগানো সরকারিভাবে বন্ধ আছে। তাছাড়া এই গাছ পানি শোষণ করে খুব বেশি। অন্যদিকে কৃত্রিম বনায়ন সৃষ্টি হচ্ছে যেখানে আকাশিয়াসহ ইত্যাদি বিদেশি গাছ রয়েছে। এর বিপরীতে প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া বন, দেশিয় প্রজাতি ও ঔষধিজাতীয় গাছগাছড়া কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে। কোন গাছ আমাদের প্রকৃতির জন্য, মানুষের জন্য উপকারী আর লাভজনক সে ব্যাপারে কমলগঞ্জের স্কুল শিক্ষক থেকে শুরু করে কয়েকজন মধ্য বয়স্ক ব্যক্তি তাদের অভিমত জানালেন। তাদের মতে- আম, কাঁঠাল, কালোজাম, অর্জুন, জারুল, জলপাই, নিম, তেঁতুল, মেহগনি, সেগুন, শিরিষ, আমলকি, কৃষ্ণচূড়া, শিলকড়াই, ঝাউ, শিমুল, হিজল, তেজপাতা, হরিতকি, বহেরা, গর্জন ইত্যাদি। এদের মধ্যে অনেক গাছই রয়েছে ঔষধি বৃক্ষ। আগেকারদিনে এসকল ঔষধি গাছ এবং লতাগুল্ম থেকে হেকিম ও কবিরাজরা মানুষকে চিকিৎসা করতো। আর এখন বাংলাদেশের লোকজনকে বিদেশি কাঠ ও ফলের গাছ এবং হাইব্রিড জাতীয় শাকসবজি ও শস্যদানা এইরূপ অর্থকরী ফসলের চাষাবাদে উৎসাহিত করা হচ্ছে। ফলে দেশিয় প্রজাতির মূল্যবান কাঠ ও ফলের গাছ এবং ঔষধি বৃক্ষের চাষ উৎপাদনের ও সংরক্ষণের বিষয়টি প্রায় উপেক্ষিত হয়ে আছে। অথচ দেশিয় প্রজাতির কাঠ, ফল ও ফসলাদির ক্ষেত্রে ও সেরকম অর্থ ও শ্রম ব্যয় করলে অধিকতর ভাল ফলন সম্ভব বলে অভিমত জানালেন কমলগঞ্জের তারকা কৃষক মোবাশ্বির আলী।
বাংলাদেশে বর্তমানে যেসব আয়ুবের্দিক ও ইউনানী ঔষুধ কারখানা রয়েছে এবং এ সংক্রা- ব্যবসায় যারা জড়িত তারা ভারত থেকে ঔষুধের কাঁচামাল, গাছগাছড়া ও বীজ আমদানি করে। যদি দেশিয় প্রজাতির ঔষধি গাছগাছড়া দিয়ে বনায়ন করা যায় তাহলে আমদানিনির্ভর না হয়ে প্রচুর বৈদেশিক মুর্দ্রা অর্জন সম্ভব বলে সচেতন ও বিজ্ঞ মহলের ধারণা।

নূরুল মোহাইমীন মিল্টন
কৃষক, কমলগঞ্জ, মৌলভীবাজার

কোন মন্তব্য নেই: