রবিবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০০৯

ইউরিয়া স্প্রেঃ আব্দুল আজিজ ফর্মূলা

ইউরিয়া স্প্রেঃ আব্দুল আজিজ ফর্মূলা

দেশ বাঁচতে পারে ৮ হাজার কোটি টাকার আমদানি ব্যয় থেকে?






মাটি ও মানুষের কৃষি ডেস্ক
ইউরিয়া ব্যবহারের আরেক ফর্মূলা রীতিমত সাড়া ফেলেছে। ক’দিন চ্যানেল আই সংবাদে প্রচারিত হচ্ছে বিষয়টি। ঘাটাইলের আব্দুল আজিজ নামের একজন কৃষক ইউরিয়া প্রয়োগের প্রচলিত সব পদ্ধতি বাদ দিয়ে পানিতে গুলিয়ে স্প্রে করছেন। আর এর মধ্য দিয়ে ইউরিয়ার ব্যবহার কমানো যাচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ ভাগ। কোথাও তার চেয়েও বেশি। এ পদ্ধতির চাক্ষুস সফলতা পেয়েছেন তিনি। জানা গেছে, প্রায় ১৬ বছর ধরে বিভিন্ন ফলফলাদির গাছে পানিতে ইউরিয়া মিশিয়ে প্রয়োগ করে আসছেন কৃষক আজিজ। এতে আনারসে ৫৬ শতাংশের এক পাখি (স্থানীয় হিসাব) জমিতে ৬ হাজার কেজি ইউরিয়ার চাহিদা মিটে যাচ্ছে মাত্র ৬০ কেজিতে, আবার উচ্চফলনশীল কুল যেমন বাউকুল, আপেল কুল কিংবা থাই কুলের ক্ষেত্রে এক একর জমিতে যেখানে প্রায় দু হাজার কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করে কৃষকরা সেখানে এ পদ্ধতিতে মাত্র ২০ কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করলেই পাওয়া যাচ্ছে কাঙ্ক্ষিত ফলন।
বিস্ময়কর এ তথ্য পাওয়ার পর মাটি ও মানুষের কৃষি’র পক্ষ থেকে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে বিষয়টির বাস্তôবতা। ঘাটাইলের শালিয়াবহ গ্রামের আব্দুল আজিজের হাত ধরে এ পদ্ধতি পৌঁছেছে অনেক দূর। এবার বোরো মৌসুমকে সামনে রেখে আব্দুল আজিজের ফর্মূলায় ইউরিয়া প্রয়োগ করছেন অনেকেই। তার কাছ থেকে অন্য কৃষকরা ইউরিয়া স্প্রে’র চুলচেরা হিসাব জেনে যাচ্ছেন। ১৬ লিটার পানিতে মাত্র ২০০ গ্রাম ইউরিয়া মিশিয়ে যে দ্রবণ তৈরি করা হচ্ছে তা স্প্রে মেশিনের মাধ্যমে ২০ শতাংশ জমিতে প্রয়োগ করা যাবে। এই প্রক্রিয়ায় দুই থেকে তিনবার প্রয়োগ করলেই মিটে যাবে এক মৌসুমে ধানে ইউরিয়ার প্রয়োজনীয়তা। সেখানে ২০ শতাংশ জমিতে তিন দফা ইউরিয়া প্রয়োগের মাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রথম দফায় ১৬ লিটার পানিতে ২’শ গ্রাম, দ্বিতীয় দফায় ২৫০ গ্রাম এবং তৃতীয় দফায় ৩০০ গ্রাম সর্বমোট ৭৫০ গ্রাম ইউরিয়া প্রয়োগের। এই হিসেবে ৩৩ শতাংশের এক বিঘা জমিতে ইউরিয়ার প্রয়োজন হচ্ছে মাত্র ১ কেজির কিছু বেশি। প্রচলিত পদ্ধতিতে কৃষক যেখানে ১ বিঘা বোরো ধানের জমিতে ৪৫ থেকে ৫০ কেজি পর্যন্তô ইউরিয়া ছিটিয়ে আসছে সেখানে এই পরিমাণ শুধু নগণ্যই নয়, বিস্ময়কর বটে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কৃষিতত্ত্ব বিভাগের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড· আব্দুল মজিদ বলছেন, বিষয়টি বিজ্ঞান বহির্ভূত নয় বরং এ পদ্ধতিতে প্রয়োগ করে ইউরিয়ার চাহিদা অনেক কমানো সম্ভব। তিনি সহযোগী বিজ্ঞানীদের নিয়ে ব্রি’র গবেষণা প্লটে প্রাথমিক পরীক্ষা নীরিক্ষার পর জানান, আব্দুল আজিজের পদ্ধতিতে ইউরিয়া প্রয়োগের মাত্রা ১ দশমিক ২। চারটি প্লটে ওই মাত্রার কাছাকাছি চার মাত্রায় ইউরিয়া স্প্রের পর তিনি জানান, আব্দুল আজিজের ইউরিয়া প্রয়োগ পদ্ধতি যথার্থই বিজ্ঞানস্মত এবং কার্যকর। কারণ, এই প্রক্রিয়ায় ধান গাছ পাতার অসংখ্য ছিদ্রের মাধ্যমে সরাসরি ইউরিয়া গ্রহণ করতে পারে। এতে খুব দ্রুতই গাছ পুষ্ট হয়ে ওঠে। যা ফলনের জন্যও ইতিবাচক। বিজ্ঞানীদের এই মন্তব্যের সঙ্গেও মাটির বিজ্ঞানী আব্দুল আজিজের মন্তôব্য মিলে যায়। আজিজ তার ভাষায় বলেছিলেন, গাছের তো মুখ কিংবা দাঁত নেই, তাই সে পাতার অসংখ্য ছিদ্রের মাধ্যমেই নাইট্রোজেন গ্রহণ করে। বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন-এ কর্মরত কৃষি প্রকৌশলী ইফতেখারুল ইসলামও আব্দুল আজিজের ইউরিয়া স্প্রে পদ্ধতির প্রতি সমর্থন জানিয়ে বলেন, ছিটিয়ে ইউরিয়া প্রয়োগ করলে ধান ফসলের জন্য তা ২০ ভাগেরও কম কাজ করে, গুটি ইউরিয়া প্রয়োগ করলে এর চেয়ে কিছুটা উপকার পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে, মাত্রা অনুযায়ী ইউরিয়া স্প্রে করলে তার ফলাফল পাওয়া যাবে প্রায় শতভাগ। যেহেতু ধানের শেকড়ের অংশ উপরিভাগেই বেশি সেহেতু স্প্রে করা হলে সেটিই কার্যকরভাবে গ্রহণ করতে পারে। এদিকে এই প্রক্রিয়ায় মাটিতে নাইট্রোজেন ঘাটতি দেখা দিতে পারে কি-না জানতে চাইলে প্রকৌশলী ইফতেখারুল ইসলাম জানান, ইউরিয়া স্প্রে করা হলে তা শুধু ধান গাছেরর পাতাই গ্রহণ করে না, মাটিও তার প্রয়োজন অনুযায়ী গ্রহণ করে। এর মধ্য দিয়ে মাটিতে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়ার প্রয়োগ কমানো সম্ভব, যার মাধ্যমে মাটি ফিরে পেতে পারে তার হারানো উর্বরা শক্তি। তবে এ ক্ষেত্রে ইউরিয়া স্প্রের বেলায় মাত্রা নির্ধারণের বিষয়টি নিয়ে আরও কার্যকর গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
এদিকে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে- বর্তমান সময়ে দেশে বছরে ইউরিয়ার মোট চাহিদা সাড়ে ২৮ লাখ মেট্রিকটন। এর মধ্যে সাড়ে ১৪ লাখ মেট্রিক টন আমদানি করা হচ্ছে আন্তôর্জাতিক বাজার দর হিসেবে যার মূল্য দাঁড়ায় ৮ হাজার কোটি টাকার উপরে। আমদানি ও অভ্যন্তôরীণ উৎপাদন মিলিয়ে বছরে ইউরিয়া প্রয়োগ করা হচ্ছে ১২ থেকে ১৬ হাজার কোটি টাকার। যদিও সরকারি ভর্তূকির কল্যাণে সরকারের ৩০ থেকে ৬০ টাকায় কেনা ইউরিয়া কৃষক এখনও কিনতে পারছে কেজি প্রতি ১২ টাকায়, তারপরও দেশের প্রচুর অর্থ ব্যয় হচ্ছে কৃষির এই উপকরণ বাবদ। আব্দুল আজিজের পদ্ধটি যদি বিজ্ঞানসম্মতভাবে পুরোপুরি কার্যকর হয় তাহলে দেশ কৃষি আবাদে ইউরিয়ার ব্যবহার আশি ভাগ কমিয়ে আনতে পারবে বলে ওয়াকিবহাল মহলের অভিমত। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, পদ্ধতির যদি অর্ধাংশও সঠিকভাবে কার্যকর করা যায় তাহলেও ইউরিয়া আমদানির হাত থেকে রেহাই পাবে বাংলাদেশ। বাঁচবে কমপক্ষে ৮ হাজার কোটি টাকা। তবে এ বিষয়টি নিয়ে কার্যকর গবেষণাই এখন সময়ের দাবি।

কোন মন্তব্য নেই: