রবিবার, ২৫ জানুয়ারী, ২০০৯

দেশি মাছ রক্ষার উপায়-৩

দেশি মাছ রক্ষার উপায়-৩



এর আগে দুটি পর্বে দেশি জাতের মাছ রক্ষার কৌশলের কথা উল্লেখ করেছিলাম। আমি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে এ লেখাগুলো লিখছি। অনুসন্ধিৎসু মন ও ব্যবসায়ীক চিন্তা থেকে আমি এ কাজগুলো করছি। কাজগুলো করতে গিয়ে মনে হয়েছে মনযোগ সহকারে কোন কাজ করলে অবশ্যই সফল হওয়া যায়। এ পর্বে পুকুরে কীভাবে শোল মাছের পোনা উৎপাদন করা যায় তার বিবরণ থাকছে-
শোল মাছের প্রজননের অভিজ্ঞতার কথাঃ ২০০০ সালে অমি বিভিন্ন হাওড়-বাওড় থেকে বিভিন্ন আকৃতির প্রায় হাজার খানেক শোল মাছ সংগ্রহ করি প্রজননের জন্য। এর আগে ১৯৯৮ সালে দেশি মাগুর ও ১৯৯৯ সালে শিং, ২০০০ সালে চিতল ও ফলি মাছের প্রজননে সফলতা পাই। আগামী পর্বগুলোতে এ বিষয়ে বিস্তারিত লেখার আশা রাখছি। শিং ও মাগুর মাছের প্রজননে সফলতাই আমাকে শোল মাছের প্রজননে উদ্বুদ্ধ করে। আগেই উল্লেখ করেছি, হাওড়-বাওড় থেকে প্রায় হাজার খানেক শোল মাছ সংগ্রহ করি। পুকুরে ব্রুড শোল মাছগুলোকে মজুদ করার পর ব্যাপক ক্ষত দেখা দেয়। তখন ছিল শীতকাল। শীতকালে শোল মাছে এমনিতেই ব্যাপক ক্ষত রোগ দেখা দেয়। বিভিন্ন চিকিৎসা শেষে মাছ সুস্থ হল কিন্তু হাজার খানেক থেকে ৮০ টির মত কংকাল সার মাছ পাওয়া গেল। কোন খাবার খায় না। খাবার নষ্ট হতে হতে পুকুরের পানি নষ্ট হয়ে গেল। অজানা পথে অনেক টাকার অপচয় করলাম। এ দিকে শোলমাছগুলোকে আমার পাকা পুকুরে স্থানান্তর করলাম। শোল মাছগুলোকে পাকা পুকুরে স্থানান্তর করার পর আরও কয়েকটি মাছ মারা গেল। কোন অবস্থাতেই খাবার খাওয়াতে পারছিলাম না। অনেক টাকা বিনিয়োগ করার পরও যখন কোন অবস্থাতেই শোল মাছগুলোকে খাওয়াতে পারছিলাম না। একদিন সন্ধ্যাবেলায় ওই পুকুরের পাড়ে বসেছিলাম। হঠাৎ করে একটি ছোট ব্যাঙ লাফ দিয়ে পুকুরে পড়ে গেল।
আর পড়ে যাওয়া মাত্রই কয়েকটি শোল মাছগুলো দৌড়ে এল। মুহূর্তের মধ্যেই ব্যাঙটিকে নিয়ে গেল। সেই মুহূর্তে আমিও পেয়ে গেলাম শোল মাছের খাবার। যারা খালেবিলে মাছ ধরে তাদের ছোট ব্যাঙ ধরে আনতে বললাম। প্রথম দিন প্রায় ৫ কেজি ব্যাঙ ধরে পাকা পুকুরে ছাড়া মাত্রই সমস্ত পুকুর জুড়েই এক ঝলকে তাণ্ডব হয়ে গেল। ৫ মিনিটের মধ্যেই সমস্ত ব্যাঙগুলোকে উদরে পুড়ে ফেলল ক্ষুধার্থ শোল মাছগুলো। প্রথম দিকে আমি এ দৃশ্য দেখে খুবই তৃপ্তি পাচ্ছিলাম। কিন্তু পর মুহূর্তে আমার মধ্যে একটা অনুশোচনা কাজ করল এই জন্য যে, এতগুলো ব্যাঙকে এ ভাবে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়া উচিৎ হয়নি। সপ্তাহখানেক শোল মাছকে খাবার না দিয়ে পরবর্তীতে আবার ব্যাঙ দিতে শুরু করি এই ভেবে যে, সবই একটি ধারাবাহিক পদ্ধতির মধ্যে চলে। বিলে এই মাছ থাকলে কোন না কোনভাবে ব্যাঙ বা অন্যকোন জলজ প্রাণী খেয়ে বেঁচে থাকতো। এভাবে নিয়মিত ব্যাঙ খাওয়ানোর পর মাছগুলো হয়ে উঠল বেশ মোটাতাজা। এরপরে এল বৈশাখ মাস। মাছগুলোর পেটে ডিম এল।
প্রজনের জন্য একজোড়া পুরুষ ও একজোড়া স্ত্রী শোল মাছ নির্বাচন করলাম। ২টি মাত্রায় পি·জি· হরমোন দিয়ে ইঞ্জেকশান করলাম। ২টি মাত্রাতেই ডিম দিল ঠিকই কিন্তু পুরুষ মাছের র্স্পাম পাওয়া গেল না। তাড়াতাড়ি পুরুষ মাছের পেট কেটে টেস্টিজ বের করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু অন্যান্য মাছের মত শোল মাছের টেস্টিজের আকার স্পষ্ট না থাকায় বুঝা যাচ্ছিল না কিছুই। অনেকটা ফুলের মত টেস্টিজে র্স্পাম থেকে কেটে তাড়াতাড়ি ডিমের সাথে পাখির পালকের সাহায্যে মিশিয়ে বোতল জারে দেয়া হল। কিন্তু ডিমগুলো বোতল জারে ভেসে উঠল। ডিমগুলো পানিতে ভেসে থাকাতে দেখে খুবই আশ্চর্য হলাম। এর আগে কখনও মাছের ডিম পানিতে ভেসে থাকতে দেখিনি।


এ যেন এক নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম আমি। শোল মাছের ডিম পানিতে ভেসে থাকতে দেখে মনে হল এভাবে ডিম ভেসে থাকলে ডিম হয়তোবা ফুটবে না। সে ধারণা থেকে ডিমগুলো জার থেকে সরিয়ে সিস্টার্ণে নামিয়ে রাখলাম। পরে ডিমগুলোকে একটি লোহার দণ্ডের ফ্রেম বানিয়ে ফ্রেমের নীচে আটকিয়ে পানিতে ডুবিয়ে রাখা হল। এভাবে প্রায় ২ দিন পর দেখা গেল ফ্রেমের নীচে ডুবন্ত ডিমগুলো নষ্ট হয়ে গেছে কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে যে ডিমগুলো পানিতে ভাসমান ছিল সে ডিমগুলো থেকে কয়েকটি বাচ্চা পাওয়া গেল। এ দিকে একই সময়ে যে পুকুর থেকে মাছগুলোকে ধরে এনে পাকা পুকুরে রেখেছিলাম সে পুকুরে কয়েকটি মাছ ছিল এবং সেখানে প্রাকৃতিকভাবে ২টি বাইশ (শোল মাছের ঝাঁক) দেখলাম। তখনই পাকা পুকুরের সমস্ত মাছগুলোকে পূর্বের পুকুরে স্থানান্তর করলাম। মাছগুলো স্থানান্তরের ১৫ দিন পর প্রচুর পরিমানে শোল মাছের বাইশ (শোল মাছের পোনার ঝাঁক) দিতে লাগল। আর তখন এই বাইশগুলোকে ঠেলে জাল দিয়ে ধরে একের পর সিস্টার্ণে ভরতে লাগলাম। প্রথমে কোন খাবার খাচ্ছিল না। পরে চিংড়ির শুটকি ভালভাবে পাউডার করে দেয়ার পর ধীরে ধীরে খেতে শুরু করল। সপ্তাহখানেকের মধ্যে শোল মাছের বাচ্চাগুলো চিংড়ির শুটকি খেতে অভ্যস্ত হয়ে গেল। এভাবে ১ মাসে প্রায় ২/৩ লক্ষ শোল মাছের পোনা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু শোল মাছের চাষ পদ্ধতি জানা না থাকার কারণে বাজারজাত করা যায়নি। শেষ পর্যন্ত পাশের বিলে অবমুক্ত করা হল। অনেক টাকা বিনিয়োগের লোকসান ঘটিয়ে শোল মাছের পোনা উৎপাদনের পরিসমাপ্তি ঘটল। (চলবে)

- এ· কে· এম· নূরুল হক

1 টি মন্তব্য:

Unknown বলেছেন...

শুভেচ্ছা জানবেন।
আপনার দেশি মাছ রক্ষার উপায় সিরিজের সবগুলো লেখাই পড়ে খুব ভাল লাগল।

আপনার নিজের অভিজ্ঞতা আপনি খুব সুন্দর আর সহজভাবে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন। আমরও জানতে পারলাম আপনার অভিজ্ঞাতা যা আমাদেরও অনেক কাজে আসবে।

আপনাকে BdFISH-এ লেখার জন্য আমন্ত্রন জানাচ্ছি। BdFISH site এর ঠিকানা - www.bdfish.info

শুভেচ্ছান্তে
এবিএম মহসিন
সমন্বয়কারী
বিডিফিশ টিম