রবিবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০০৯

দেশি মাছ রক্ষার উপায়-২

দেশি মাছ রক্ষার উপায়-২






প্রথম পর্বে প্রকৃতির পরিবর্তনকে মেনে নিয়ে কীভাবে দেশি ছোট জাতের মাছের বংশ বৃদ্ধি করা যায় এ বিষয়ে আলোকপাত করেছিলাম। আমাদের ধানের উৎপাদন একদিকে যেমন বাড়াতে হবে অন্যদিকে ভিটামিনের চাহিদা পূরণের সর্বাত্মক উৎপাদনের চেষ্টা চালিয়ে যেত হবে। আমাদের দেশে ছিল এক সময় গোলা ভরা ধান, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ। সেদিনের বাস্তôবতা আর বর্তমানের প্রেক্ষিত সবকিছু বিবেচনা করেই আমাদের এগোতে হবে। আগের ইতিহাসে যদি আমরা ফিরে যাই তাহলে দেখবো যে, আগে জনসংখ্যা ছিল অনেক কম। সে হিসেবে জমির পরিমাণ ছিল বেশি।


প্রচুর জলাশয়, ভূমি তখন অব্যবহৃত থেকে যেত। জলাশয়গুলোতে অবাধে মাছ বিচরণ করতো বছরের পর বছর। মানুষের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন হত অনেক বেশি। উদাহরণস্বরূপ ধানের ক্ষেত্রে বলা যায়, বর্তমানের চেয়ে ধানের উৎপাদন অতীতে অনেক কম হলেও শেরশাহ এর আমলে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত। এ কথাগুলো লেখার অর্থ হল অতীত ও বর্তমান প্রেক্ষিতের একটি বাস্তôবচিত্র তুলে ধরা। আমাদের এই বাস্তôবতাকে মেনে নিয়ে সামনের দিকে এগোতে হবে। আমাদের প্রাকৃতিক জলাশয় সংকুচিত হয়ে আসছে। সেজন্য এই অবস্থানের কথা চিন্তôা করেই আমাদের দেশিয় ছোট ছোট প্রজাতির মাছগুলো রক্ষার বা প্রজননের উদ্যোগ নিতে হবে। আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে মলা মাছ কীভাবে পুকুরে চাষ করতে হয় তা উলেস্ন্লখ করছি-
পুকুরে মলা মাছের চাষঃ পুকুরেই হবে মলা মাছের চাষ। আগে আমরা দেখতাম খালে-বিলে দল বেঁধে মলা মাছ চলাফেরা করতো। আর এরা ধরাও পরতো ঝাঁকে ঝাঁকে। ছোটবেলায় আমরা খুব মজা করে মলা মাছ মারতাম- বিশেষ করে ছিপজাল দিয়ে। কোন এক স্রোতের মুখে এই জাল ফেলে বসে থাকতাম। পানি একটু স্বচ্ছ হলে পরিস্কার দেখা যেত দল বেঁধে মলা মাছ আসছে। ঘাপটি মেরে বসে থাকতে পারলে পুরো মলা মাছের দলটিকে জালে উঠিয়ে ফেলা যেত।


পুরো দল মানে অনেক মাছ। এই মাছটি বর্তমানে বিপন্নের পথে। অথচ একটু চেষ্টা করলেই এই মাছটিকে আবার ফিরিয়ে আনা সম্ভব। মলা মাছের পুষ্টিগুণ ও ওষুধিগুণের কথা সবারই কম বেশি জানা আছে। মলা মাছ পুকুরেই ডিম দিয়ে থাকে। দরকার শুধু উদ্যোগের। একবার শুধু কিছু মলা মাছকে পুকুরে ছেড়ে দিলেই হল। এটা কিন্তু আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। মাস দুয়েক পর থেকেই মলা মাছ পুকুরে ডিম দিতে শুরু করে। একক চাষেও মলা মাছের সম্ভাবনা আছে। একক চাষের জন্য প্রথমে পুকুরে রটেনন দিয়ে অবঞ্চিত মাছ মেরে ফেলতে হবে। তারপর চুন দিয়ে পরিস্কার পানিতে পুকুর পূর্ণ করতে হবে। পানি ৩ ফুট রাখা বাঞ্চনীয়। এরপর আশপাশের যেকোন উৎস হতে কিছু মলা মাছের পোনা বা বড় মলা মাছ পুকুরে ছাড়তে হবে। জীবিত মলা মাছ পরিবহন করা কিছুটা ঝুঁকিপূর্ণ।


তাই আশেপাশের যে কোন উৎস হতে খুব সর্তকতার সাথে মলা মাছ বহন করতে হবে। একবার মাছ স্টক হলেই হল। প্রজননের জন্য আর কিছুর প্রয়োজন নেই। মাসখানেক পর থেকেই মলা মাছ ডিম দিতে শুরু করবে। প্রথম দুইমাস কোন মাছ ধরা যাবে না। শুধু বংশ বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে। দুইমাস পর থেকে প্রতি ১৫ দিন অন্তôর অন্তôর মাছ আহরণ করা যাবে। মাছ আহরণের সময় এমন জাল ব্যবহার করতে হবে যাতে শুধু বড় মলা মাছগুলো জালে উঠে আসে। আর ছোট মাছগুলো জালের ফাঁক দিয়ে পুকুরে চলে যায়। এভাবে প্রতি ১৫ দিন পর পর মাছ ধরা যাবে। মলা মাছের প্রচুর পরিমাণে প্রজননের জন্য অমাবস্যায় বা পূর্ণিমার রাতে পুকুরে শ্যলো দিয়ে পানি দেয়ার ব্যবস্থা করলে পর্যাপ্ত পরিমাণে বাচ্চা পাওয়া যাবে। খাবার হিসেবে শুধুমাত্র অটোকুঁড়া ব্যবহার করা উচিত। খাবার পুকুরে ভাসিয়ে দিতে হবে। অন্য খাবার ব্যবহার করলে পুকুরের পানির রঙ সবুজ হয়ে যেতে পারে। পানি বেশি সবুজ হলে মলা মাছের ডিমপাড়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে বা বাচ্চা দেয়ার হার কমে যেতে পারে। কারণ, মলা মাছ স্বচ্ছ পানিতে বাস করতে ও প্রজনন করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এ জন্য খাবার হিসেবে অটোকুঁড়া দিলে ভাল। অটোকুঁড়া পানিতে ভেসে থাকে বিধায় সমস্তô খাবার মাছে খেয়ে ফেলতে পারে। তাই পানিও পরিস্কার থাকে।

মলা মাছের বাজারজাতঃ মলা মাছ একটি নরম প্রকৃতির মাছ। পুকুর থেকে মাছ আহরণের পর মলা মাছকে বেশিক্ষণ স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রাখা যায় না। ২ থেকে ৩ ঘন্টা পর থেকেই মলা মাছ পচে যাওয়া শুরু করে। তাই মলা মাছকে পুকুর থেকে ধরেই বরফ দিতে হবে। এভাবে মাছ সংরক্ষণ করলে ১২ থেকে ১৮ ঘন্টা পর্যন্তô টাটকা অবস্থায় রাখা যায়। এ সময়ের মধ্যে দেশের যে কোন প্রান্তে বাজারজাত করা সম্ভব।

মলা মাছের উপযোগিতাঃ মলা মাছ চাষের খাদ্য খরচ কম। পোনা কিনতে টাকার দরকার হয় না এবং বাজারমূল্য উচ্চ হওয়ার কারণে বাণিজ্যিকভিত্তিতে চাষ করা যেতে পারে।

- এ· কে· এম· নূরুল হক

কোন মন্তব্য নেই: