রবিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০০৯

দেশি মাছ রক্ষার উপায়-১


দেশি মাছ রক্ষার উপায়-১






আমাদের দেশে আগে হাওড়-বাওড়-বিলে এক সময় প্রচুর পরিমাণে দেশিয় প্রজাতির মাছ পাওয়া যেত। এসব প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট হাওড়-বাওড়গুলোর কিছু কিছু জায়গায় সারা বছরই পানি থাকতো। এতে বছর শেষে প্রচুর পরিমাণে দেশিয় প্রজাতির মাছ থেকে যেত যা থেকে পরবর্তী বছরে দেশিয় প্রজাতির মাছের জন্ম হত। কিন্তু দিনে দিনে প্রাকৃতিকভাবে এসব হাওড়-বাওড়গুলোর তলা ভরাট হয়ে যাওয়াতে এসব আশ্রমগুলো সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। আগে যেখানে সারাবছর পানি থাকতো সেখানে আজ ভরা মৌসুমেও পানি থাকে না। যার কারণে এসব শুকিয়ে যাওয়া হাওড়-বাওড়গুলোতে এখন ধান আবাদ হচ্ছে। এর পরে অনেক জলাভূমিতে পানি থাকলেও সেখানে মাছের অি-ত্ব থাকা পর্য- সেচ দিয়ে এসব মাছগুলোকে মেরে সাফ করে দেয়া হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে পরের বছর মাছের প্রজন্মের জন্য অবশিষ্ট আর কিছুই থাকছে না।


এভাবে দেশিয় প্রজাতির মাছ এখন প্রায় বিলুপ্তির পথে। ইতিমধ্যে অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। চৈত্র-বৈশাখের খরার পর আষাঢ়ে বৃষ্টির পানি পেলেও মাছের দেখা মেলে না আজকাল। ছোটবেলায় দেখেছি আষাঢ়ের বৃষ্টির পর ডোবা, খাল, বিল ছোট ছোট মাছে- যেমন মলা, দারকিনা, কয়েক প্রজাতির পুটি মাছ, টেংরা, গুলশা, খলিশা, চান্দা ইত্যাদি নানান প্রজাতির মাছে ভরে যেত। কিন্তু এখন আষাঢ়ে বৃষ্টি হলে খালে-বিলে পানি হলেও এসব মাছ আগের মত দেখা যায় না। নিবিড় পর্যবেক্ষণ করে আমি দেখেছি, খালে-বিলের এসব ছোট ছোট মাছ প্রতিমাসেই একবার করে বাচ্চা দেয়। যার ফলে ভরা বর্ষা মৌসুমে এসে খাল-বিল মাছে ভরে যেত। কিন্তু বর্তমানে মাছে আর আগের মত ডিম দিতে পারে না। এর কারণ, কয়েক মাস পানি থাকলে ছোট মাছের বংশ বৃদ্ধি ঘটে না।

আগের ইংরেজ শাসকদের শাসন আমলকে যে জোঁকের সাথে তুলনা করা হত সেই জোঁকও এখন আর খালে-বিলে পাওয়া যায় না। অথচ আমরা ছোটবেলায় দেখেছি জোঁকের জন্য খালে-বিলে নামা যেত না। পানিতে নামলেই বিভিন্ন প্রজাতির জোঁক আসতো ধরতে। এখন বৈশাখ-জৈষ্ঠ্যেও সেই জোঁকের দেখা মেলে না। আগে শামুকের দেখাও মিলতো প্রচুর। খাল-বিলের পাড়ে প্রচুর পরিমাণে সাদা শামুকের ডিমের ছোট ছোট -ূপ দেখা যেত। বিভিন্ন মৎস্য খামারের খাদ্য হিসেবে শামুক ব্যবহার হওয়াতে এখন শামুকের সংখ্যাও কমে গেছে। এর জন্য দায়ী আমরাই।


নানা কারণের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণে রাসায়নিক সার ব্যবহার করছি আমরা। এ ছাড়াও অবাধে কীটনাশক ব্যবহার করছি। কীটনাশক ব্যবহারের ফলে এসব মাছ, শামুক বা প্রাণীর প্রজনন ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে। ফলে বর্ষা মৌসুমেও মাছের বংশবৃদ্ধি হচ্ছে না। কয়েক মাস ধরে খাল-বিল থেকে দূষিত পানি বেরিয়ে যাবার পর মাছের প্রজনন উপযোগী হতে হতে ততদিনে মাছের প্রজনন মৌসুম শেষ হয়ে যায়। এর পরেও একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণের ছোটমাছ বংশ বৃদ্ধি করে। এভাবেই আমাদের দেশের ছোট মাছের বংশ বৃদ্ধির হার একেবারে কমে গেছে। হারিয়ে গেছে বা বিলুপ্ত হয়ে গেছে অনেক প্রজাতির মাছ। সমাপ্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে একটি অতীত ঐতিহ্যে।
আমরা প্রচুর টাকা খরচ করে নানা জায়গায় সেমিনার করছি। কিন্তু বা-বে কাজ করছি কম। ঐতিহ্যকে ধরে রাখার পক্ষে কোন কাজই করে যাচ্ছি না। আমরা সবাই মিলে সচেতন হলে কিছুটা হলেও এসব ছোটমাছ রক্ষা করতে পারবো। প্রাকৃতিক জলাশয় বিভিন্ন কারণে সংকুচিত হচ্ছে এটাকে মেনে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। কেননা, আমাদের খাদ্য চাহিদার বিপরীতে ধানের আবাদ যেমন বাড়ছে তেমনি বাড়ছে এর সাথে সংশ্লিষ্ট কীটনাশকের ব্যবহার।

আমাদের সবদিকেই খেয়াল রাখতে হবে। ধানের উৎপাদনের কথা মাথায় রাখতে হবে। আবার মাছের বংশ বৃদ্ধির কথাও চিন্তা করতে হবে। কেননা, প্রকৃতি যেভাবে যাচ্ছে আমাদেরও সেভাবে যেতে হবে। কারণ, প্রকৃতিকে ধরে রাখার সামর্থ আমাদের নেই। তবু বিভিন্নভাবে এর লাগাম টেনে এর গতি মন্থর করতে হবে। প্রকৃতির সাথে খাপ খাইয়েই প্রকৃতিকে জয় করতে হবে। আর তাই বৈশাখ-জৈষ্ঠ্যেও বৃষ্টির কিছুদিন পর পানিতে বিষক্রিয়া কিছুটা কমে গেলে যখন মাছ প্রাকৃতিক জলাশয়ে ডিম পাড়া বা বাচ্চা দেয়া শুরু করবে তখনই কারেন্টজালের ব্যবহার কঠোর হাতে দমন করতে হবে। প্রথমত, যদিও সরকারিভাবে কারেন্টজাল ব্যবহার নিষিদ্ধ, কিন্তু এর কোন প্রয়োগ বা-বে লক্ষ্য করা যায় না। আমি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি যে, জৈষ্ঠ্যে যে মাছগুলো ডিম পাড়ে সেই বাচ্চাগুলোই পরবর্তীতে ২/৩ মাস পর থেকে আবার প্রাপ্ত বয়স্ক হয়ে আবার বাচ্চা দিয়ে থাকে। বিশেষ করে দারকিনা, পুটি, ছোট খলিশা, কৈ, খলিশা, টাকি, শিং ইত্যাদি। আর তাই এদের প্রজননের ওপর বিশেষভাবে সচেতন হলে এখনও আশ্বিন-কার্তিকে এসে প্রচুর পরিমাণে ছোটমাছ পাওয়া সম্ভব। কিন্তু বা-বে যা ঘটে তা হল যখন বৈশাখে প্রথম বাচ্চা হয় সেই বাচ্চাগুলো প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার আগেই কারেন্টজাল দিয়ে সমূলে বিনাশ করা হয়। গ্রামাঞ্চলে যে কি পরিমাণে কারেন্টজাল ব্যবহার করা হয় তা হয়তোবা অনেকেরই জানা নেই। খাল-বিলে অসংখ্য কারেন্টজাল অবাধে ব্যবহার করা হয় নিয়মিত প্রতিযোগিতার মত।


শুধু কারেন্টজালের ব্যবহার বন্ধ করতে পারলেই এইসব ছোট ছোট মাছের উৎপাদন জ্যামিতিকহারে বহুগুণ বেড়ে যাবে, এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। দ্বিতীয়ত, সীমিত আকারে হলেও উপজেলাভিত্তিক একটি করে মৎস্য অভয়াশ্রম গড়ে তোলা উচিত। অভয়াশ্রমগুলো এভাবে করা উচিত যেন আশ্রমের একদিক দিয়ে পানির স্রোত এসে অন্য দিক দিয়ে স্রোত বয়ে যেতে পারে। তাতে বর্ষার প্রাক-মৌসুমে প্রচুর পরিমাণে এইসব ছোট ছোট মাছ ডিম ছাড়তে পারে। যা পরবর্তীতে এই সব মৎস্য অভয়াশ্রাম হতে ছোট মাছের মাতৃমাছ বা ছোটমাছ স্থনারিত হয়ে সম- এলাকা ছড়িয়ে যাবে। যেহেতু এইসব ছোটমাছ খুবই দ্রুত এক জায়গা হতে অন্য জায়গায় স্থানা-রিত হয়ে থাকে। এ ছাড়াও কিছু কিছু ছোট মাছকে পুকুরেই বংশ বৃদ্ধি করানো যেতে পারে। এ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে ধারাবাহিকভাবে লেখার আশা রাখছি। (চলবে)

- এ· কে· এম· নূরুল হক

কোন মন্তব্য নেই: