রাণীক্ষেত নিয়ন্ত্রণে আশার আলো
রাণীক্ষেত মুরগি বা পাখি জাতীয় প্রাণীর ভাইরাসজনিত মারাত্মক রোগ। বাংলাদেশ তথা বিশ্বের পোল্ট্রি শিল্পের জন্য এ রোগ হুমকি স্বরূপ। স্বাস্থ্যগত ব্যবস্থাপনা ও সঠিক সময়ে গুণগত মানসম্পন্ন টিকা প্রদানের মাধ্যমে এ রোগ দমন করা যায়। তবে টিকা প্রদানের পর মুরগির শরীরে পর্যাপ্ত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা এন্টিবডি তৈরি হয়েছে কিনা তা হিমাগ্লুনেশন ইনহিবিশন অর্থাৎ এইচআই পরীক্ষার মাধ্যমে জানতে হবে। এজন্য প্রয়োজন এইচআই এন্টিজেন। এইচআই পরীক্ষার জন্য এ এন্টিজেন পূর্বে বিদেশ থেকে আমদানি করা হত বলে অনেক অর্থ ব্যয় হত। বাংলাদেশ পশুসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট অর্থাৎ বিএলআরআই ইতোমধ্যে স্বল্প খরচে এইচআই এন্টিজেন উৎপাদনের প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, আমদানিকৃত এন্টিজেন ও বিএলআরআই উদ্ভাবিত এন্টিজেন সমমানের।
প্রযুক্তির উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্যঃ
০ বিদেশ থেকে এইচআই এন্টিজেন আমদানি করে পরীক্ষা করলে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয় হয়। কিন্তু স্বল্প খরচে এইচআই এন্টিজেন দেশে উৎপাদন করা হয়েছে বলে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হয়;
০ আমদানিকৃত ও দেশে প্রস্তুতকৃত এন্টিজেন সমভাবে কার্যকরী;
০ প্রযুক্তিটি ব্যবহারে পরিবেশের ওপর কোন বিরূপ প্রভাব নেই।
এন্টিজেন উৎপাদনের জন্য যা প্রয়োজনঃ
০ ৯ থেকে ১০ দিন বয়সের মুরগির ভ্রূণঃ বিশেষভাবে পালনকৃত প্যারেন্ট স্টক হতে সংগ্রহকৃত ফুটানোর উপযোগী সাদাডিম ৯ থেকে ১০ দিন ইনকিউবেট করে এ ভ্রূণ তৈরি করতে হয়;
০ সনাক্তকৃত স্থানীয় ভাইরাস/ টিকা ভাইরাস এর ১০-৩ ডাইলেশনের নমুনা;
০ ডিম ছিদ্র করার যন্ত্র;
০ সিরিঞ্জ ০·১ মিলি দাগ কাটা;
০ স্কচটেপ বা মোম;
০ জীবাণুনাশক দ্রবণ মিশ্রিত তুলা (জীবাণুনাশক হিসেবে আয়োডিন যৌগ ব্যবহার করা উত্তম);
০ ভ্রূণ পরীক্ষা করার যন্ত্র;
০ পিবিএস;
০ ফরমালিন;
০ সেন্ট্রিফিউজ মেশিন;
০ মাল্টিচ্যানেল পিপেট, টিপস ও টেস্টটিউব;
০ লাইয়োফিলাইজার/ ফ্রিজ ড্রায়ার ।
এন্টিজেন উৎপাদন পদ্ধতিঃ
০ জীবাণুনাশক যৌগ মিশ্রিত তুলা দিয়ে ৯ থেকে ১০ দিন বয়সের ভ্রূণায়িত ডিম ভালভাবে মুছে জীবাণুমুক্ত করতে হবে;
০ ভ্রূণ পরীক্ষা করার যন্ত্রের সাহায্যে প্রথমে ভ্রূণায়িত ডিমের পূর্ণ বায়ুথলি অঞ্চল চিêিহ্নত করে ভ্রূণের যে এলাকায় রক্তনালী কম সে এলাকা বরাবর একটি উলম্ব দাগ দিতে হয়;
০ উলম্ব দাগটি বায়ুথলির দাগের সাথে যে জায়গায় মিলিত হয়েছে সে জায়গার ০·২৫- ০·৫ ইঞ্চি উপরে ডিম ছিদ্র করার যন্ত্র দিয়ে একটি ছিদ্র করতে হবে। যন্ত্রটি অবশ্যই জীবাণুনাশক যৌগ মিশ্রিত তুলা দিয়ে ভালভাবে মুছে নিতে হবে;
০ পূর্বে টাইট্রেশন করা ১০-৩ ডাইলেশনের ভাইরাস বা ইনোকুলাম থেকে সিরিঞ্জের সাহায্যে ০·১ মিলি ইনোকুলাম ভ্রূণের এলানটোয়িক পথে ইনজেকশন করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে যেন সূচের মাথা ভ্রূণের গায়ে আঘাত না করে। একই ধরনের ও বয়সের কিছু ভ্রূণায়িত ডিম কন্টোল হিসেবে রাখতে হবে যার মধ্যে শুধু ০·১ মিলি পিবিএস প্রয়োগ করতে হবে;
০ ইনজেকশনের ছিদ্রটি মোম বা স্কচটেপ দিয়ে বন্ধ করে দিতে হবে;
০ ডিমগুলোকে পুণরায় ইনকিউবেটরে স্থাপন করে ৪ থেকে ৫ দিন রাখতে হবে এবং প্রত্যেকদিন পরীক্ষা করতে হয়। প্রথম ২৪ ঘন্টায় যে ভ্রূণগুলো মারা যাবে সেগুলো দুর্ঘটনাজনিত মৃত বলে গণ্য হবে। পরবর্তীতে যে ভ্রূণগুলো জীবিত থাকবে সেগুলো ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। পঞ্চম দিনে যে ভ্রূণগুলো জীবিত থাকবে সেগুলোকেও ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে;
০ পরবর্তী দিনে ডিমগুলো থেকে এলানটোনিক ফ্লুইড বা তরল সংগ্রহ করতে হয়। সেক্ষেত্রে প্রতিটি ডিম থেকে প্রায় ১০ মিলি ফ্লুইড সংগ্রহ করতে হবে;
০ ডিম পরীক্ষা করার জন্য একটি গ্লাস ্লাইডে ৫০ মাইক্রোলিটার বা এক ড্রপ এলানটোয়িক ফ্লুইড এবং সমপরিমাণ ৩% চিকেন জইঈ মিশাতে হবে। ভাইরাস প্রয়োগকৃত ডিমের ফ্লুইড চিকেন জইঈ এগ্লুটিনেশন ঘটাবে। অপরপক্ষে কন্ট্রোল ডিমের ফ্লুইড এগ্লুটিনেশন ঘটবে না;
০ রাণীক্ষেত রোগের ভাইরাস হিমাগ্লুটেশন ঘটাচ্ছে কি না তা সঠিকভাবে জানার জন্য এইচআই পরীক্ষা করতে হবে। এজন্য ভাইরাস প্রয়োগকৃত প্রতিটি ডিমের এলানটোয়িক ফ্লুইড থেকে দু’সট দু’ফোল্ড ডাইলুশন করতে হবে। এক সেটে রাণীক্ষেত রোগের জন্য পজিটিভ সিরাম এবং অন্য সেটে জানা নেগেটিভ সিরাম মিশাতে হবে। আধ ঘন্টা কক্ষ তাপমাত্রায় রেখে সমপরিমাণ ০·৫% চিকেন জইঈ উভয় সেটে মিশাতে হবে। এ অবস্থায় ৩০ থেকে ৬০ মিনিট রেখে ফলাফল পর্যবেক্ষণ করতে হবে। পজিটিভ সিরাম হিমাগ্লুটিনেশন এ বাধা দিবে এবং নেগেটিভ সিরাম তা পারবে না;
০ উক্ত ফ্লুইড বা তরল ভালভাবে ছেঁকে নিয়ে ১ঃ ১৬০০ ডাইলেশন হিসেবে ফরমালিন যোগ করে ভালভাবে মিশাতে হবে। অতপর ১৫০০ ৎঢ়স এ ১০ মিনিট সেন্ট্রিফিউজ করতে হবে। পরিশেষে উপরের ফ্লুইড সংগ্রহ করে এইচ এ টাইট্রেশন করে এন্টিজেনিক ক্ষমতা নির্ণয় করতে হবে;
০ তরল হিসেবে উক্ত এন্টিজেন -২০০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা যায় বা লায়োফিলাইজ করে ৪০ সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ট্যাবলেট আকারে সংরক্ষণ করা যায়। এন্টিজেন ট্যাবলেট ১ মিলি পিবিএস- এ গুলানোর পর টাইট্রেশন করে ব্যবহার করতে হবে। এ এন্টিজেন প্রতিবার ব্যবহারের আগে এন্টিজেনিক ক্ষমতা নির্ণয় করে নিতে হবে। একবার ক্ষমতা নির্ণয় করে পরীক্ষা করার পর পরবর্তী পরীক্ষার সময় পূর্বের এন্টিজেনিক ক্ষমতা বিবেচনা না করে পুনরায় পরীক্ষা করে ক্ষমতা নির্ণয় করতে হবে।
প্রযুক্তি ব্যবহারে লাভক্ষতিঃ স্বল্প খরচে এ এন্টিজেন উৎপাদন করে এইচআই পরীক্ষার জন্য এন্টিজেনের সহজপ্রাপ্যতা নিশ্চিত করা সম্ভব যা রাণীক্ষেত রোগ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিদেশ থেকে আমদানি করা এন্টিজেনের ডোজ প্রতি খরচ পড়ে ৫ টাকা অথচ একই গুণসম্পন্ন বিএলআরআই কর্তêৃক উদ্ভাবিত ডোজ প্রতি খরচ পড়ে মাত্র ০·১০ টাকা। সে হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয়ের বিষয়টি সহজেই অনুমেয়।
প্রযুক্তি ব্যবহারে সর্তকতাঃ শুধু লেন্টোজেনিক বা মেসোজেনিক ভাইরাস মুরগির ভ্রূণে চাষ করে এবং ফরমালিন দিয়ে উক্ত ভাইরাসকে নিস্ত্র্নিয় করে এন্টিজেন উৎপাদন করতে হবে। কখনই এন্টিজেন উৎপাদনে ভেলোজেনিক ভাইরাস ব্যবহার করা যাবে না।
রাণীক্ষেত রোগ যে কোন বয়সের মুরগিতে হতে পারে। বাচ্চা মুরগিতে এ রোগে মারা যাওয়ার হার শতকরা ৯০ ভাগের উপরে। বয়স্ক মুরগিতে মৃত্যুর হার কিছুটা কম।
- মোঃ তৌফিক আরেফীন, ঢাকা
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন