সংসদ নির্বাচনে কৃষকদের কী লাভ হবে?
১৯৭০ সাল। কাগজ, চিনির দাম কমবে এমনি এক আশায় কৃষককে বলা হল নৌকায় ভোট দেওয়ার জন্য। কৃষক নৌকায় ভোট দিল। নৌকা জিতল। এরপর স্বাধীনতা যুদ্ধের সূত্রপাত হল। কৃষক স্বাধীনতার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করল। দেশ স্বাধীন হল। অনেক অনেক দিন আগের কথা। তবু মনে হয় এইতো সেদিন।
আজ ২০০৮ সাল। স্বাধীনতার ঠিক ৩৮ বছর পর আমাদের সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। দেশে টানটান উত্তেজনা নির্বাচনকে নিয়ে। আর এমনটা হওয়ারই কথা। সংসদহীন দেশে সংসদ আসবে। আনন্দে ভরবে সবার মন। কিন্তু আমি একজন কৃষক হিসেবে কী পাব তা কিন্তু আমার জানা নেই। কারণ আমার বাবা, দাদা ১৯৭০ সালে ভোট দিয়েছিলেন স-ায় চিনি পাওয়ার আশায়। স্বাধীনতার ৩৮ বছর পর অন্যান্য জিনিসের তুলনায় চিনি স-া তা আমি হলফ করে বলতে পারি। কিন্তু চিনি খেতে যে চাল, ময়দা লাগে তার দাম আজ আকাশ ছোঁয়া। চাল, ময়দা উৎপাদন করতে যে সার লাগে তা কৃষকের নাগালের বাইরে। বলতে গেলে দুষ্প্রাপ্য। আর কাগজ? কাগজ দিয়ে কি করব? চাষার ছেলেমেয়েরাতো দেশের ভাল স্কুল, কলেজে ভর্তির সুযোগ থেকে বঞ্চিত। আজ নয়, অনেকদিন আগের থেকেই। দিনদিন শহর ও গ্রামের শিক্ষার মধ্যে তৈরি হচ্ছে উঁচু প্রাচীর। এখন বড় ধরনের চাকরিতে অনেক গ্রামের ছেলেমেয়ে পাওয়া যায়। ভবিষ্যতে গ্রামের একটি ছেলেমেয়েও উচ্চ পর্যায়ের চাকরিতে পাওয়া যাবে বলে আমার মনে হয় না। কৃষকের ঘাম আর রক্তের উপর গড়ে উঠেছে যে নগর সভ্যতা, সেই নগর সভ্যতায় কৃষক আজ উপেক্ষিত। কৃষকের ভাগ্য আজ নগর সভ্যতার বেড়াজালে বন্দি। নগর সভ্যতার পদতলে বারবার আছড়ে পড়ছে কৃষকদের বেঁচে থাকার করুণ আকুতি। স্বাধীনতার পর বহু জাতীয় সংসদ নির্বাচন এসেছে। কৃষকদের বারবার স্বপ্ন দেখানো হয়েছে, কৃষকেরা আশায় বুক বেঁধেছে। কিন্তু কৃষকেরা কী পেয়েছে? আজকে কৃষকদের অবস্থা কেমন, কোন রাজনৈতিক দল খবর রাখে? রাখে না।
সারের দাম আকাশ ছোঁয়ার কারণে এবার আমন মৌসুমে কৃষকেরা সার ছাড়া আবাদ করেছে। যার ফলে ফসল কম হচ্ছে। খবরটা রাখেন কোন রাজনৈতিক নেতা, কোন রাজনৈতিক দল? এগুলোর খবর তাদের দরকার নেই। দরকার আছে নির্বাচনের। যে নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদল হয়। ফলে একটা বিশেষ শ্রেণী লাভবান হয়। স্বাধীনতার পরে আমরা অনেক শুনেছি- কৃষকই জাতির মেরুদণ্ড। কই, কৃষকের ছেলেমেয়েরা যখন উচ্চ শিক্ষার জন্য ডাক্তারী, ইঞ্জিনিয়ারিং অথবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারে না, তখন তো আপনারা একবারও বলেন না যারা আমাদের মেরুদণ্ড (কৃষক/চাষি) তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য মেডিক্যাল ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা কোটা থাকতে হবে। শিক্ষাই আলো, শিক্ষার প্রতিযোগিতায় আমরা যারা চাষা, তাদের ছেলেমেয়েরা পিছিয়ে পড়ছে। গ্রাম অঞ্চলে শিক্ষায় সুযোগ-সুবিধার অভাবে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, প্রতিটি চাকরিরক্ষেত্রে চাষার ছেলেমেয়েদের জন্য আলাদা কোটা হওয়া দরকার। এটা কৃষকদের প্রাণের দাবি। মানবতার দাবি।
যারা খাদ্য উৎপাদন করে দেশ বাঁচাবে তাদের স-ানেরা থাকবে অবহেলিত তা কখনও হতে পারে না। আমরা যারা চাষা তাদের প্রাণের দাবি- আমরা যেমন দেশ উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা রাখছি, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাও আমাদের দিতে হবে। অত্য- আক্ষেপের সাথে বলছি, আমরা যখন সারের জন্য আবাদ করতে পারছি না, সেই সংকটময় অবস্থাতে কোন কোন রাজনৈতিক দল মুখ খুলে উচ্চকণ্ঠে বলেনি, সবার আগে কৃষকদের সারের সমস্যার সামাধান করতে হবে। হে শিক্ষিত সুধী, সমাজ বসবাসরত চাষারাতো তাদের নিজেদের জন্যই ফসল ফলাই না। আমাদের ফলানো ফসল খেয়ে আপনারাও বাঁচেন। আমাদের সারের সংকট নিজেদের সংকট হিসেবে বিবেচনা করার অনুরোধ করছি। স্বাধীনতার পরে যারা চাকরিজীবি, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সবারই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু চাষাদের অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি, বরং কঠিন থেকে কঠিনতর হয়েছে। উবশী, হাইব্রিড ফসল বীজের সংকট হয়েছে, সার দুষ্প্রাপ্য, চলছে প্রযুক্তি সংকট। কৃষকেরা প্রয়োজনীয় তথ্য ও জ্ঞানের অভাবে যথেচ্ছা কীটনাশক ব্যবহার করে নিজের আর্থিক, শারীরিকভাবে যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন, তেমনি বিষক্রিয়াযুক্ত সবজি খেয়ে সমাজের সর্ব-রের মানুষও নানা রোগে আক্রা- হচ্ছে। যারা ধনী, চাকুরিজীবি, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ তাদের রোগ হলে তারা চিকিৎসা করাতে পারে। তাদের সে আর্থিক সঙ্গতি আছে। কিন্তু কৃষকের রোগ হলে কোথায় যাবে? কে আছে দরদী পাশে দাঁড়ানোর মত? চিকিৎসাইবা করবে কি দিয়ে কৃষক? টাকা কই তাদের? যাদের নুন আনতে পা-া ফুরায় তাদের আবার চিকিৎসা! তাই আমরা যারা চাষা, তাদের প্রাণের দাবি, নির্বাচনের আগে সব রাজনৈতিক দলের অঙ্গীকার করতে হবে, নির্বাচনে জিতলে সারসহ সব কৃষি উপকরণের সংকট দূর করতে হবে।
প্রযুক্তি সম্প্রসারণে, গ্রাম ও শহরের শিক্ষার বৈষম্য নিরসনে, উৎপাদিত পণ্যের ন্যাযমূল্য পাওয়ার জন্য কাজ করবেন। এগুলো বা-বায়িত হলে সংসদ নির্বাচন কৃষকদের জন্য সুফল বয়ে আনবে। না হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কৃষকদের কোন লাভ হবে না। আমি আশা করি রাজনৈতিক দলগুলো উপরে উল্লেখিত দাবিগুলোর প্রতি গুরুত্ব দিয়ে কৃষকদের ভাগ্য ফিরানোর জন্য কাজ করবেন। আমি স্বপ্ন দেখি এমন একটি সোনালি দিনের।
- মোঃ রফিকুল ইসলাম
কোরবাণী ও নিরাপদ পশুর মাংস
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন