রবিবার, ৯ নভেম্বর, ২০০৮

মুন্সীগঞ্জের আলু চাষিদের কথা


মুন্সীগঞ্জের আলু চাষিদের কথা


- শাইখ সিরাজ
গত মৌসুমে বোরো ধানের কাঙ্ক্ষিত ফলন লাভের খবরের পাশাপাশি কৃষির আরেক বিস্ময় ছিল আলুর ব্যাপক উৎপাদন। উৎপাদন হয়েছে ৮০ লাখ টন। আগের বছরের চেয়ে উৎপাদন বেশি হয় ২৫ লাখ টনেরও বেশি। এত বেশি আলু অতীতে কখনোই উৎপাদিত হয়নি। আলুর বাম্পার ফলন দেশবাসীকে যেভাবে উচ্ছ্বসিত করেছে, একইভাবে সংরক্ষণ সমস্যার কারণে টন কে টন আলু পচে নষ্ট হওয়ার ঘটনা শুধু কৃষককেই হতাশ করেনি, ব্যথিত করেছে দেশবাসীকেও। কোল্ড-স্টোরেজে নষ্ট হওয়া অতিরিক্ত আলু অপসারণ এবং কৃষক ও কোল্ড-স্টোর মালিকদের ক্ষতির মধ্য দিয়ে সে অধ্যায়ের শেষ নামলেও আলুই এখন নতুন করে দুশ্চি-ার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কৃষি উৎপাদন, সংরক্ষণ ও বিপণনের ক্ষেত্রে সমন্বিত ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি থাকলে কৃষককে যে কতটা অসহায় অবস্থা বরণ করতে হয়, এবার আলু রোপণ মৌসুম শুরুর ঠিক আগেই তা দেখা যাচ্ছে। মুন্সিগঞ্জের আলু চাষ অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় এবার কৃষকদের হিসাব নিকাশ একেবারেই পাল্টে গেছে। গতবারের বেশি আবাদ আর বেশি ফলন যেভাবে কৃষকের বুক ভরিয়ে দিয়েছিল এবার সামনে ঠিক ততটাই অনিশ্চয়তা। বেশিরভাগ কৃষকই সিদ্ধা- নিয়ে ফেলছেন এবার কমিয়ে আনবেন আলু চাষ। সব রকম সারের দ্বিগুণ তিনগুণ মূল্য বৃদ্ধি এবং আলুর মূল্য ক্রমেই কমতে থাকার কারণে বাধ্য হয়েই কৃষককে নিতে হচ্ছে এই সিদ্ধা-। শুধু তা-ই নয়, কয়েকজন কৃষক জানালেন তারা এবার ঝুঁকবেন তামাক চাষে। উল্লেখ্য, মুন্সিগঞ্জ এলাকায় অনেক আগে থেকেই অল্প বি-র তামাকের আবাদ হত। বছর বছর আলুর ভাল ফলন এবং মোটামুটি মূল্য পাওয়ায় কৃষক নিজে থেকেই তামাক আবাদে খুব বেশি উৎসাহিত ছিল না। কিন্তু এবার আলুর ভাল ফলন পাওয়ার পর দুই দফায় কৃষক হোচট খেলো। অর্থাৎ কোল্ড-স্টোরেজে স্থান সংকটে সমুহ ক্ষতির শিকার হওয়ার পর যতটুকু আলু বাঁচানো গেছে তার মূল্য উৎপাদন খরচের তুলনায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এখন মণ প্রতি চার হাজার টাকা মূল্য পাওয়ার স্বপ্নে কৃষক বেছে নিতে যাচ্ছে তামাক উৎপাদনের পথ। কারণ কৃষক জানে, তামাক চাষ করতে গেলে তাকে সার সংকটে পড়তে হবে না। যার প্রভাব পড়তে যাচ্ছে আগামী মৌসুমে।
সারের দাম যে গতিতে বেড়েছে, সে গতিতে বাড়েনি আলুর দাম। শহর নগরে আলুর নিম্নমূল্য বোঝা না গেলেও উৎপাদন এলাকার কৃষকরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন তাদের প্রধান কৃষিপণ্যের নিম্নমূল্যই সবচেয়ে বেশি অনিশ্চয়তায় ফেলেছে। কোল্ড-স্টোরেজগুলোতে কৃষকের শত শত মণ আলু যেখানে আর্থিক লাভের স্বপ্ন দেখাবে, সেখানে দেখাচ্ছে দারুণ দুঃস্বপ্ন। সেদিন নূর কোল্ড স্টোরেজে বেশ কিছু সংখ্যক কৃষকের সঙ্গে দেখা হল। ব্যবসায়ীরাও ছিলেন সেখানে। ছিলেন কোল্ড-স্টোরের লোকজনও। এই পর্যায়ে এসে আলু নিয়ে সবার হতাশা এখন যেন সমান। একজন ব্যবসায়ী বললেন, ৩০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করে আলুর ব্যবসা করতে এসে এবার সর্বশা- হয়ে পড়েছেন তিনি। একজন কৃষক বললেন, উত্তরাঞ্চলে আলুর উৎপাদন এবার বেশি হওয়ায় মুন্সিগঞ্জের কৃষকরা এই সমস্যায় পড়েছেন। অন্যান্য বছর এ মৌসুমে একেকটি কোল্ড-স্টোরেজের সামনে নৌকা ও অন্যান্য যানবাহনে আলু সরবরাহের ব্য-তা থাকলেও এবার দেখা যাচ্ছে ভিন্ন চিত্র। একেবারেই স্থবির অবস্থা। চাষির সঙ্গে সঙ্গেই পদে পদে ব্যবসায়ীদেরকে ক্ষতির হিসাব করতে হচ্ছে। একজন কৃষক বললেন, সরকার জনগণকে আলু খাওয়ার ব্যাপারে যেভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে ঠিক সেই মাফিক আলুর স্থানীয় বিপণন ও রফতানির ব্যাপারে কার্যকর কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
খোদ কৃষি বিভাগ বলছে, এবার জেলায় ২ থেকে ৩ হাজার হেক্টর কম জমিতে আলু উৎপাদিত হবে। আলু আবাদি এলাকা হ্রাসের হার আরও বাড়তে পারে। কৃষি বিভাগ যদিও তামাক চাষে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, তারপরও লাভের আশায় কৃষক যে এদিকে ঝুঁকবে না এর নিশ্চয়তা নেই। কারণ, এভাবেই নানা কারণ সামনে নিয়েই দেশের একেকটি এলাকায় ঢুকে পড়ে তামাক চাষ।
মুন্সিগঞ্জে নতুন করে তামাক চাষের তৎপরতায় কৃষিতে মারাত্মক বিপর্যয় নেমে আসতে পারে - এমন আশংকার কথা জানালেন কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উর্দ্ধতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড· মোঃ আজিজুল হক। তিনি বললেন, একটি জমিতে একবার তামাক চাষ করা হলে শুধু সেই জমিই ক্ষতিগ্র- হবে তা নয়, তার আশেপাশের অন্যান্য ফসলও ক্ষতিগ্র- হতে থাকবে। এই কারণেই যেভাবেই হোক এই বিপর্যয়ের হাত থেকে ওই এলাকার কৃষিকে বাঁচাতে হবে।
খাদ্য নিরাপত্তার প্রশ্নে বর্তমান সময়টি একটি সন্ধিক্ষণ বলা যায়। যখন এক বিন্দু খাদ্যকণার মূল্য সম্পর্কেও মানুষ সচেতন হতে শুরু করেছে - তখন কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা এবং আবাদ স্বাভাবিক রাখার বিষয়টি অত্য- গুরুত্বপূর্ণ। এখনও সময় আছে, রোপণ মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই কৃষকদের হতাশা কাটিয়ে তোলার উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে উপকরণের মূল্য কৃষকদের ক্রয়সীমার মধ্যে আনা, কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ সুবিধা দেওয়াসহ সময়োপযোগী নানামুখি কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে, খাদ্যশস্যের আবাদি জায়গা যেন খাদ্যদ্রব্য নয় এমন কৃষিপণ্যের দখলে না চলে যায়। এটি সময়েরই চ্যালেঞ্জ।

কোন মন্তব্য নেই: