সভ্যতার নতুন ভাইরাস ‘খাদ্য সংকট’
তথ্য আমাদের সব সময়ের সঙ্গী। আর সেই তথ্য যদি একের পর এক প্রতিকূল হলেও সত্য হয়, তার ভার বহন করা আরও দুরূহ হয়ে দাঁড়ায়। জাতিসংঘের বিশ্বখাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফ·এ·ও) তথ্যমতে এ বছরই অতিরিক্ত খাদ্যমূল্যের কারণে ৪০ মিলিয়ন মানুষ ক্ষুধার্তের কাতারে পড়েছে। এই তথ্যের সাথে আরও যে বাড়তি তথ্য যুক্ত হল তা হল, ২০০৭ সালে সারাবিশ্বে ৯২৩ মিলিয়ন অপুষ্টিজনিত মানুষ ছিল। যা এ বছর, অর্থাৎ, ২০০৮ সালে বেড়ে দাঁড়াল ৯৬৩ মিলিয়নে। এরই সাথে জন্ম নিচ্ছে অর্থনৈতিক সংকট। ক্ষুধা আর দারিদ্র্য ছড়িয়ে পড়ছে বিশ্বের প্রতিটি কোণে। আর তাই, বর্তমান সময়ের সবচাইতে নীরব এবং নৃশংস ভাইরাসের নাম নিশ্চিতভাবেই, ‘খাদ্য সংকট’-এ কথা বললে তেমন বড় কোন ভুল হওয়ার সুযোগ নেই। যদিও ২০০৮ সালের গোড়ার দিকে খাদ্যমূল্য কিছুটা হলেও প্রশমিত হয়েছিল, কিন্তু বিশ্বের বহু দরিদ্র দেশে ক্ষতির আর জীবনযুদ্ধের চিত্রই যেন অতিমাত্রিক প্রকটরূপেই রয়ে গেছে। সম্প্রতি এফ·এ·ও প্রকাশ করেছে এক নয়া রিপোর্ট, ‘বিশ্ব খাদ্য অনিরাপত্তা ২০০৮’।
পৃথিবী দিনের পর দিন যে এক নাজুক অবস্থানে চলে যাচ্ছে ‘খাদ্য সংকট’-এর কারণে, তারই এক অনুপম দৃষ্টা- হল রিপোর্টটির নামকরণ। অবশ্য এ নামে পূর্বেও রিপোর্ট প্রকাশ করেছে এফ·এ·ও। এফ·এ·ও উপ-মহাসচিব হাফেজ ঘানেম এই রিপোর্টটি পেশ করতে গিয়ে ভয়াবহ সব তথ্য তুলে ধরলেন গত ৯ ডিসেম্বর, রোমে অবস্থিত এফ·এ·ও-এর হেডকোয়ার্টারে। হাফেজ ঘানেম বলেছেন, “বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে মানুষ তার শরীর সচল এবং সুস্থ রাখতে যতটুকু খাবার গ্রহণ করতে চায় তা অচিরেই এক অলীক স্বপ্নে পরিণত হতে চলেছে। ক্ষুধার এই কাঠামোগত সমস্যার সাথে জড়িয়ে আছে জমি এবং কৃষিঋণ স্বল্পতা। সাথে রইলো উচ্চ খাদ্যমূল্যের মত একটি নিষ্ঠুর বা-বতা।” যদিও প্রধান খাদ্যশস্যের দাম এ বছরের গোড়ার দিকে বেশ কমেছিল, কিন্তু দুঃখের বিষয় হল গত কয়েক বছরের দামের পরিসংখ্যানে দেখা যায় এ বছরের গোড়ার দিককার দাম পূর্বের বছরগুলো থেকে অনেক বেশি ছিল। সুতরাং যে ক্ষতি হবার কথা ছিল তা ইতোমধ্যে সাধিত হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে স্বল্প দাম মনে হলেও মূলত অতি-দরিদ্রের সাধ্যের বাইরে চলে গিয়েছে খাদ্যশস্যের দাম। ২০০৬ সালে বীজ এবং সারসহ অন্যান্য কৃষি-উপকরণের যে দাম ছিল তা এখন বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। এফ·এ·ও-এর ‘অক্টোবর, ২০০৮’ মূল্যসূচক অনেক ওপরে রয়েছে ২০০৬ সালের অক্টোবর-এর মূল্য সূচক থেকে। অন্যদিকে উন্নত দেশের কৃষকদের চিত্র খুবই স্বাভাবিক এবং উন্নয়নের ধারায় গতিশীল রয়েছে সেই বিশ্বের কৃষি।
সেই বিশ্ব বলছি কেননা উন্নত দেশের কৃষকেরা উচ্চ-মূল্যের কৃষি-উপকরণ সহজেই খরিদ করতে পারছে আর সাবলীলভাবে বাড়িয়ে চলছে চাষ-ব্যবস্থাপনা। কারণ অর্থ, অনুকূল আবহাওয়া, আবাদি জমি, কৃষি-উপকরণ- কোনকিছুরই অভাব নেই সেই চির-উন্নত বিশ্বে। এ জন্যই উন্নত বিশ্বে ২০০৮ সালে খাদ্যশস্যের উৎপাদন বেড়েছে ১০ শতাংশ। আর উন্নয়নশীল বিশ্বে যা ১ শতাংশও টপকাতে পারেনি। “যদি আগামী বছর কৃষক তার সুযোগ-সুবিধার অভাবে অপেক্ষাকৃত কম শস্য আবাদে যেতে বাধ্য হয়, সেক্ষেত্রে, আগামী বছর নাটকীয় মোড় নিতে পারে খাদ্যমূল্য এবং সেইসাথে খাদ্য সংকট আবির্ভূত হবে এক নতুন এবং আরও ভয়াল এক রূপে”- হাফেজ ঘানেম -এর পর্যালোচনা ঠিক এরকমই। হাফেজ মনে করিয়ে দিলেন ১৯৯৬ সালে বিশ্বখাদ্য সামিট-এর প্রতিজ্ঞার কথা- ২০১৫ সালের মধ্যে বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে। আর এ জন্য যা প্রয়োজন তা হল শক্তিশালী রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা এবং দরিদ্র দেশগুলোতে কৃষি এবং প্রাি-ক মানুষের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিনিয়োগ। দরিদ্র দেশগুলোতে এই বিনিয়োগের অংকটি বিশাল আর তা হল প্রতিবছর ৩০ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বের অধিকাংশ অপুষ্টিজনিত মানুষের বাস, অর্থাৎ ৯০৭ মিলিয়ন, উন্নয়নশীল বিশ্বে (সুত্রঃ ‘বিশ্ব খাদ্য অনিরাপত্তা ২০০৭, এফ·এ·ও)। এই বিরাট অংকটির ৬৫ শতাংশ মানুষ বাস করছে মাত্র সাতটি দেশে। দেশগুলো হল ভারত, চীন, কঙ্গো, বাংলাদেশ, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্থান এবং ইথিওপিয়া।
বিশ্বের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ ক্ষুধার্ত মানুষ (৫৮৩ মিলিয়ন) বাস করছে এশিয়াতে। শুধুমাত্র এশিয়ায়, বিশ্বখাদ্য নিরাপত্তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পেরেছে থাইল্যান্ড এবং ভিয়েতনাম। উপ-সাহারিয় আফ্রিকায় সংখ্যাটি হল ২৩৬ মিলিয়ন। কঙ্গোতে ২০০৩-২০০৫ সাল পর্য-, মাত্র এই দুবছরে, ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ১১ মিলিয়ন থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩ মিলিয়নে, অর্থাৎ ২৯ থেকে ৭৬ শতাংশে! গত কয়েক বছরে, কঙ্গোর উদাহরণটি সবচাইতে ভয়াবহ, এতে কোন সন্দেহ নেই। আফ্রিকায় একমাত্র ঘানা সফল হয়েছে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি এই সফলতার পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করেছে। খাদ্যমূল্যের চরম উর্ধ্বগতির আগেই দক্ষিণ আমেরিকা এবং ক্যারিবিয় অঞ্চল ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা অনেকটাই কমিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। এদিকে আফগানি-ান এবং ইরাকে ১৯৯০-৯২ সময়ে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ১৫ মিলিয়ন যা ২০০৭ সালে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৭ মিলিয়নে। খাদ্য অনিরাপত্তার প্রত্যেকটি ফলাফল আক্রা- করেছে অতি-দরিদ্র জনগোষ্ঠি, ভূমিহীন এবং বিশেষ করে নারীদের। ২০১৫ সালের মধ্যে ক্ষুধার্ত জনগোষ্ঠির হার কমিয়ে আনতে এখন প্রয়োজন বৈশ্বিক সহযোগিতা। আর তেমনটি না হলে, দিনের পর দিন ভয়াবহ বা-বতার সম্মুখিন হতে হবে বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রতিটি দেশকেই।
যে উন্নত বিশ্ব এখন নিশ্চি- রয়েছে, তারাও একদিন হোঁচট খাবে। মুখ থুবড়ে পড়বে। কারণ অর্থই সবচাইতে বড় কথা নয় যা দিয়ে সবকিছুই মোকাবিলা করা যায়। যেভাবে বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তিত হচ্ছে, সেক্ষেত্রে যে কোন শক্তিশালী দেশ কুপোকাত হওয়াটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। তাই সম্মিলিতভাবে, একটি দেশ আর একটি দেশের প্রতি তার সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে মোকাবিলা করবে খাদ্য সংকট, এমনটি কাম্য আমাদের সকলের। ‘খাদ্য অনিরাপত্তা’ নিয়ে আর ভাবতে হবে না আমাদের। মানব-ভাইরাস, ‘খাদ্য সংকট’-কে মোকাবিলা করা যাবে দৃঢ়ভাবে- আমাদের সকলের ঐকাি-ক আশা ঠিক এমনই।
- তৌফিক আহমেদ
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন