এই শীতে খেজুরের রস ও গুড়
ঋতুচক্রের পাখায় ভর করে বাংলাদেশের প্রকৃতিতে এখন শীতকাল। শুরু হয়েছে শীত-পার্বণের মেলা। চারিদিকে পিঠা-পায়েস খাওয়ার পড়েছে ধুম। আছে শীতের সকালে খেজুর রস আর পাটালি গুড়। সে নানা বৈচিত্র। খেজুরের রস ও পাটালি গুড় শীতকালীন রসনা তৃপ্তির ব্যাপারে অতুলনীয়। পাটালি গুড়ের তৈরি শীতের নানারকম পিঠাপুলি বা মিষ্টান্ন দিয়ে অতিথি আপ্যায়ণ গ্রামবাংলার মানুষের দীর্ঘকালের ঐতিহ্য। মেয়েজামাই বাড়ি বা কাউকে খুশি করতে এই পাটালি আর পিঠার জুড়ি নেই।
প্রকৃতির অপার দান এই খেজুরের রস। শক্ত গাছের বুক চিরে সুস্বাদু মিষ্টি রস বের করে আনা পলস্ন্লী এলাকার মানুষের দীর্ঘকালের ঐতিহ্য। খেজুর গাছ কেটে যারা রস বের করেন তাদের বলা হয় গাছি। কার্তিক মাস এলেই তারা গাছ কাটার শুরু করেন। তাদের কাছে থাকে দুটি লম্বা দা, এর মধ্যে একটি দীর্ঘ ও ধারালো। একে বলে গাছি দা অপরটি অপেক্ষাকৃত ছোট। গাছ কাটার সময় গাছি ওই দা সাধারণত বাঁশের তৈরি একটি ঝাঁপিতে রাখেন। ঝাঁপিটি শক্ত করে বাঁধা থাকে কোমরের সাথে। এছাড়া গাছির প্রয়োজন হয় শক্ত ও মোটা একটি দড়ি আর কোমর বরাবর বাঁধার জন্য এক খণ্ড চামড়া। অনেকে চামড়ার বদলে চট বা বস্তôাও ব্যবহার করেন। শরীরের পুরো ভর ওই দড়ির মাধ্যমে চামড়ার ওপর পড়ে। খেজুর গাছ কাটা হয় এক বিশেষ প্রক্রিয়ায়। গাছি দা দিয়ে খেজুর গাছের মাথার এক দিকে পাতাসহ ডগা কেটে বুক চেঁছে সেখানে গাছ কেটে বাঁশের কঞ্চির নলি বসানো হয়। তারপর বাঁধা হয় মাটির হাড়ি বা ভাঁড়। মাটির ভাঁড়ে ওই নলি দিয়ে টপটপ করে রাতভর রস জমা হয়। খেজুর গাছ কাটা থেকে শুরু করে পাটালি (গুড়) প্রস্তুত পর্যন্তô পুরো প্রক্রিয়াটিতেই দক্ষ গাছি আর গুড় প্রস্তুতকারীর ভূমিকাই মুখ্য। কার্তিক মাসে ওই গাছ তোলা হয়। রস পাওয়া যায় তখন থেকেই। এরপর অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন। কোন কোন গাছে চৈত্রমাস পর্যন্তô রস মেলে। প্রকৃতপক্ষে রস মৌসুম হল অগ্রহায়ণ থেকে মাঘ। তবে শীত যত বেশি পড়ে রস তত বেশি বাড়ে।
সাধারণত গাছ কাটার পর তিন দিন রস পাওয়া যায়। প্রথম দিনের রসের নাম জিবানকাটা। এই রস খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি গুড় তৈরির জন্য উৎকৃষ্ট। দ্বিতীয় বা তৃতীয় দিনের রসকে দো-কাটা বা তে-কাটা বলা হয়। সাধারণত তিনদিন গাছ কাটার পর মাঝখানে তিনদিন বাদ দিয়ে আবার গাছ কাটা হয়। ভাঁড়ের রস সংগ্রহের পর মাটির জালায় রস জ্বাল দিতে হয়। বাড়ির গৃহিণী, অপেক্ষাকৃত বয়স্করা রস জ্বাল দিয়ে গুড় বা পাটালি তৈরির কাজটি করে থাকেন। আশঙ্খার কথা হচ্ছে, দিন দিন খেজুর গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। ইট ভাটায় পুড়ছে খেজুর গাছ। বাগান কেটে জমি আবাদি করাসহ ঘরবাড়ি তৈরির কারণেও গাছের সংখ্যা কমছে দিন দিন।
পরিকল্পিতভাবে খেজুর গাছ লাগানোর কোন উদ্যোগ নেই। অর্থনৈতিকভাবে চাষিদের কাছে এটা তুলে ধরার সরকারি উদ্যোগও নেই। তবে আশার কথা, দেশের সর্বত্র খেজুর গাছের সংখ্যা কমলেও গাছির ব্য-তা কমেনি একটুও। আগে একজন গাছিকে যেখানে একটি এলাকা নিয়ে ব্যস্তô থাকতে হত, এখন তাদের কয়েকটি পাড়া কিংবা গ্রামে কাজ করতে হয়। যারা এখনও এ পেশায় আছেন তাদের অনেকেই বললেন প্রতিযোগীর সংখ্যা কম থাকায় আগের চেয়ে মন্দ নেই তারা। এছাড়া তারা যে পরিমাণে রস পাচ্ছেন তার সঠিক মুল্য পাওয়ায় তাদের ঠিকই পুষিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ১ ভাঁড় রস শহরাঞ্চলে আনা গেলে তা বিক্রি হচ্ছে ১শ টাকা পর্যন্তô। তবে যশোর, ফরিদপুর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়াতে এর মূল্য ৪০ থেকে ৫০ টাকা মাত্র।
- ইজাজ আহ্মেদ মিলন
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন