রবিবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০০৯

দেশি মাছ রক্ষার উপায় -৫


দেশি মাছ রক্ষার উপায় -৫






(পূর্ব প্রকাশের পর)

গত বছর চিতল মাছের কৃত্রিম প্রজননের উপর কাজ করেছিলাম। বিভিন্ন মাত্রায় ডোজ দিয়ে চিতলের কৃত্রিম প্রজনন করতে গিয়ে দেখা গেছে, চিতল মাছকে পি·জি· হরমোন দিয়ে ইঞ্জেকশন করার পর স্ত্রী চিতল মাছ ডিম পাড়লে পুরুষ চিতলের ভূমিকা খুবই কম। একইভাবে ফলি মাছের ক্ষেত্রেও চাপ প্রয়োগ পদ্ধতিতে পুরুষ মাছকে কেটে র্স্পাম মিশাতে হয়। তাই চাপ প্রয়োগে ডিম বের করার পর পুরুষ চিতল/ফলি মাছের টেস্টিজ কেটে র্স্পাম মিশিয়ে সফলতা পেলেও নিম্নলিখিত কারণে এ পদ্ধতিটি লাগসই বলে আমার কাছে মনে হয়নি।

১· চিতল মাছের ডিমের পরিমাণ খুবই কম এবং ডিমের আকার বেশ বড়। এক একটি ডিমের আকার প্রায় ছোট মার্বেলের মত। একটি বড় চিতল মাছে ৩০০ থেকে ৫০০ ডিমের বেশি থাকে না।

২· প্রাকৃতিকভাবে ডিম দিতে প্রত্যেকবার পুরুষ চিতলের র্স্পামের জন্য একটি পুরুষ চিতল মাছ কাটতে হয় যা অল্প সংখ্যক ডিমের জন্য ঠিক নয়।

৩· চিতল মাছের ডিম ফুটতে তাপমাত্রাভেদে প্রায় ১৫ দিন সময় লাগে। অন্যদিকে কার্প বা রুই জাতীয় মাছের ডিম ফুটতে ১৮ থেকে ২৪ ঘণ্টার উপরে লাগে না। দীর্ঘদিন সিস্টার্ণে ডিম রেখে অল্পসংখ্যক বাচ্চা উৎপাদন করে ব্যবসায়িকভাবে খুব একটা লাভবান হওয়া যায় না।

এ সব বিভিন্ন কারণে চিতল মাছের কৃত্রিম প্রজননে আশাপ্রদ ফলাফল পাওয়া যায়নি। কৃত্রিম প্রজননের পাশাপাশি পুকুরে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতেও চিতল মাছের বাচ্চা ফুটানো হয়। দুটি পরীক্ষা থেকে দেখা গেছে প্রাকৃতিকভাবে পুকুরেই চিতল মাছের বাচ্চা ফুটানোই ভাল।

পুকুরে চিতল মাছের পোনা উৎপাদন পদ্ধতিঃ জানুয়ারির দিকে প্রথমে পুকুরকে ভালভাবে শুকিয়ে (১৫ দিন) রাখতে হবে। এর ফলে পুকুরের তলায় এক ধরনের ঘাসের সৃষ্টি হলে পানি দিতে হবে। পানি নীচের ঘাসগুলো আস্তেô আস্তে বড় হতে হতে এক সময় পানির উপর চলে আসবে। এভাবে প্রাকৃতিক আশ্রম তৈরি হবে পুকুরে। এ ভাবে মাস খানেক পর অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসে পুকুরে চিতল মাছের মাতৃ মাছ এবং পুরুষ ব্রুড মাছ মজুদ করতে হবে। মজুদ ঘনত্ব হবে প্রতি শতাংশে সর্বোচ্চ ৩টি। ব্রুড মাছ মজুদের পর খাবার হিসেবে কার্প বা রুই জাতীয় মাছের ধানী পোনা পুকুরে ছেড়ে দিতে হবে। চিতল মাছ কিছুটা রাক্ষুসে স্বভাবের হলেও বড় মাছ খায় না। খাবার হিসেবে ছোট ছোট মাছ খেতে পছন্দ করে। কার্প জাতীয় মাছের ধানী পোনাও ছাড়াও তেলাপিয়ার ছোট ছোট বাচ্চা খেতে পছন্দ করে। সে জন্য পুকুর প্রস্তুতি এবং পানি দেয়ার পর কিছু সংখ্যক ব্রুড তেলাপিয়া ছাড়তে হবে। তাতে তেলাপিয়া প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে বাচ্চা দেয়া শুরু করবে। আর সে বাচ্চা চিতলের খাবার হিসেবে চলে যাবে।

চিতল মাছ সাধারণত এপ্রিলের শেষের দিকে অর্থাৎ জুলাই মাস পর্যন্ত অমাবস্যা বা পূর্ণিমার রাতে পুকুরে প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে ডিম দিয়ে থাকে। আর সে জন্য প্রজনন প্রক্রিয়াকে তরান্বিত করার জন্য এপ্রিলের শেষ দিক হতে জুলাই পর্যন্তô পুকুরে শ্যালো মেশিন দিয়ে পানির প্রবাহ দেয়া উচিত। তাতে চিতল মাছের প্রজনন প্রক্রিয়ায় দ্রুত সাড়া দিয়ে ডিম পাড়া তরান্বিত হবে। চিতল মাছের ডিম আঁঠাল। আর সে জন্য চিতলের ডিম সংগ্রহের জন্য বিশেষ কিছু ব্যবস্থা অবলম্বন করতে হবে। ডিম সংগ্রহের জন্য কাঠের ফ্রেম বানিয়ে দিতে হবে। কাঠের ফ্রেম অনেকটা ছোট নৌকার মত এবং তা ডুবিয়ে রাখতে হবে। চিতলের ডিম সংগ্রহের জন্য এ ব্যবস্থা নিলেই চলবে। এ প্রক্রিয়াটি এপ্রিলের আগেই করে রাখতে হবে। মে মাস থেকেই চিতল মাছ ডিম পারতে শুরু করবে। সাধারণত বর্ষা মৌসুমের প্রতি অমাবস্যা বা পূর্ণিমা রাতে এরা ডিম পারে। অমাবস্যা বা পূর্ণিমার ২/৩ দিন পর কাঠ দিয়ে বানানো নৌকাটিকে পানির উপর তুলে দেখতে হবে ডিম দিয়েছে কি-না। যদি ছোট নৌকাতে ডিম দেখা যায় তাহলে ডিমসহ নৌকাটিকে নার্সারি পুকুরে স্থানান্তôরিত করতে হবে।

নার্সারি পুকুর প্রস্তুতিঃ চিতলের ডিমের সংখ্যা যেহেতু কম সেহেতু ছোট ছোট নার্সারি প্রস্তôাত করতে হবে। সাধারণত ৫ শতাংশের পুকুর নার্সারির জন্য নির্বাচন করতে হবে। প্রথমে পুকুর শুকিয়ে পুকুরের তলায় চাষ দিয়ে শ্যালো দিয়ে পরিষ্কার পানি ২/৩ ফুট পানি দিয়ে পূর্ণ করতে হবে। তারপর চিতলের ডিমসহ ছোট নৌকাটিকে নার্সারি পুকুরে খুব তাড়াতাড়ি করে সর্তকতার সাথে এনে ডুবিয়ে রাখতে হবে। যেহেতু চিতলের ডিম ফুটতে প্রায় ১৫ দিনের মত লাগে সেহেতু ডিম দেখে নার্সারি পুকুর প্রস্তুত করা ভাল। আর তা না হলে আগেই নার্সারি পুকুর প্রস্তুত হয়ে গেলে পানি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। পানি পরিষ্কার না হলে চিতলের ডিমে ফাঙ্গাস পড়তে পারে। এ ভাবে ডিম সংগ্রহ করে নার্সারিতে নেয়ার পর তাপমাত্রাভেদে ১২ থেকে ১৫ দিনের মধ্যেই ডিম থেকে বাচ্চা ফুটে বের হবে। বাচ্চা ফুটার পর খাদ্য হিসেবে কার্প জাতীয় মাছের রেনু পুকুরে দিতে হবে। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, চিতলের বাচ্চা পূর্ণাঙ্গভাবে ফুটার পর পরই প্রায় ১/২ ইঞ্চি সাইজের হয়ে থাকে। এভাবে নার্সারি পুকুরে সপ্তাহ দুয়েক রাখার পর প্রায় ৩ ইঞ্চি সাইজের হয়ে থাকে। এরপর চিতলের পোনাকে চাষের পুকুরে ছাড়তে হবে। নার্সারি পুকুরে ১ ইঞ্চি থেকে ২ ইঞ্চি সাইজের ফাঁসের জাল রাখতে হবে যাতে সাপ আটকে যায়।

চিতলের চাষ পদ্ধতিঃ আমাদের দেশে এখনও চিতলের একক চাষ পদ্ধতি চালু হয়নি। পোনা প্রাপ্তির অভাবে মিশ্রভাবে বিচ্ছিন্নভাবে চিতলের চাষ শুরু হয়েছে। পরীক্ষা করে দেখা গেছে প্রতি ৫ শতাংশে অন্যান্য মাছের সাথে ১টি করে চিতল দিলে ১ বছরে প্রায় ২ কেজি ওজনের হয়ে থাকে। এর জন্য বাড়তি খাবারের প্রয়োজন নেই।

চিতলের রোগবালাইঃ নীবিড় পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে চিতল মাছের প্রজননের সময় পুরুষ চিতল মাছ স্ত্রী চিতল মাছের সাথে জড়াজড়ি করে একটি আরেকটিকে আক্রান্তô করে ফেলে। বিশেষ করে এদের মুখের দিকে কাঁটা বা বুকের নীচে কাঁটা দিয়ে একে অপরকে নিজের অজান্তেôই আক্রান্তô করে যা পরবর্তীতে সমস্তô শরীরে ক্ষত রোগ হিসেবে দেখা দিতে পারে। এজন্য প্রত্যেকবার ডিম দেয়ার পর পুকুরে পটাসিয়াম পার-ম্যাঙ্গানেট ছিটিয়ে দেয়া প্রয়োজন। এতে প্রজননের পর আক্রান্তô মাছগুলো দ্রুত আরোগ্য লাভ করবে। মিশ্র চাষে চিতলের রোগ বালাই নেই বললেই চলে।

উপরোল্লেখিত পদ্ধতি অনুসরণ করে করে যে কেউ চিতলের পোনা উৎপাদন করতে পারবে। যা মিশ্রচাষে খুব ভাল মুনাফা ঘরে আসবে পাশাপাশি চিতলের বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে।

- এ· কে· এম· নূরুল হক
শম্ভুগঞ্জ, ময়মনসিংহ

কোন মন্তব্য নেই: