দেশি পানি বিদেশি মাছ
মাছ আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। আমাদের আছে প্রায় ২৬০ প্রজাতির মিঠা পানির মাছ; এর মধ্যে ১৪০টিই ছোট মাছের শ্রেণীভূক্ত। বিএফআরআই এর পরিসংখ্যান মতে মিঠা পানির ২৬০ প্রজাতি মাছের মধ্যে ৫৬টি বিলুপ্তপ্রায়। এসব বিলুপ্তপ্রায় মাছের মধ্যে আছে পাবদা, গুলশা, বাটা, গনিয়া, ভাগনা, মহাশোল, কালিবাউস, মেনি ইত্যাদি মাছ। এদের স্বাদ ও দাম বিদেশি মাছের তুলনায় অনেক বেশি। রুই-কাতলা মাছ ছাড়া বাঙালির কোন উৎসব ভাবাই যায় না। শিং মাগুর মাছের কদর এখনও দেশজোড়া।
নব্বই এর দশক থেকে আমাদের দেশে মিঠা পানির মাছ চাষের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। দেশে মোট মাছ উৎপাদনের শতকরা ৪২ ভাগ এখন যোগান দিচ্ছে চাষের মাধ্যমে। অথচ বিগত দশকেও চাষের অবদান ছিল মাত্র ২০ থেকে ২৫ ভাগ। মৎস্য উপখাতে এ এক ঈর্ষণীয় সাফল্য।
মৎস্য চাষের ক্ষেত্রে চাষিরা এখন অনেক বেশি উদ্যোগী। কি করে স্বল্প সময়ে অধিক মুনাফা করা যায় তা নিয়ে চাষিদের নির-র ভাবনা। অধিক মুনাফার আশায় কোন কোন ক্ষেত্রে চাষিরা বিদেশি মাছও চাষ করে থাকে। সঠিক তথ্য না জেনে এ ধরনের বিদেশি মাছ চাষে জলজ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশংকা থাকে। বলা বাহুল্য, আমাদের দেশি পানিতে বিদেশি মাছ চাষের যেমন ভাল অভিজ্ঞতাও আছে তেমনি তিক্ত অভিজ্ঞতাও কম নয়।
আশির দশকে আমাদের দেশে থাইল্যান্ড থেকে আফ্রিকান মাগুর আমদানি করা হয়। এর গড় দৈহিক বৃদ্ধি ছিল দেশি মাগুরের চেয়ে অনেক বেশি। তাই সারা দেশে হৈ চৈ পড়ে গেল আফ্রিকান মাগুর চাষ নিয়ে। গবেষণা ফলাফলের অপেক্ষা না করেই দেশব্যাপী শুরু হয়ে গেল এর চাষাবাদ। এর পরের পরিস্থিতি আমাদের কমবেশি সবারই জানা। এক পর্যায়ে জানা গেল -এ মাছ অত্য- রাক্ষুসে স্বভাবের এবং খেতেও ততটা সুস্বাদু নয়। অতঃপর আফ্রিকান মাগুর নিষিদ্ধ করা হল। কিন্তু কে জানে ততদিনে কি পরিমাণে এই রাক্ষুসে মাগুর আমাদের নদ-নদী ও ডোবা বিলে ঢুকে পড়েছে। বন্যা উপদ্রুত এদেশে এটাইতো স্বাভাবিক। উন্মুক্ত জলাশয়ে আফ্রিকান মাগুর এখন কি পরিমাণে অন্যান্য মাছ সাবাড় করছে এর হিসেব কে রাখে?
একই অবস্থা রাক্ষুসে মাছ পিরানহা নিয়ে। এ্যাকুরিয়াম ফিস হিসেবে পিরানহা মাছ এদেশে প্রথম আসে। পরবর্তীতে তা চলে যায় চাষির পুকুরে। দেদারসে শুরু হয় দেশব্যাপী চাষাবাদ। দেশের অনেক কর্তাব্যক্তিও সংযুক্ত হন পিরানহা মাছ চাষে। থাই রূপচাঁদা বলে বাজারে চালিয়ে দেওয়া যায় পিরানহাকে। এক্ষেত্রেও প্রথম দিকে বিজ্ঞানীদের মতামতের যথাযথ গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। যাহোক, সম্প্রতি পিরানহা মাছ চাষ, বিক্রয়, আমদানি ও পরিবহন সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সরকারের এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়।
বিদেশি মাছের ক্ষেত্রে আমাদের সুখকর অভিজ্ঞতাও আছে। যেমন থাই পাঙ্গাস, তেলাপিয়া এবং থাই কই। অগ্নিমূল্যের কারণে পাঙ্গাস মাছ ছিল এক সময় উচ্চবিত্তের খাবার। নব্বই এর গোড়ার দিকে থাইল্যান্ড থেকে এদেশে প্রথম পাঙ্গাসের পোনা আমদানি করা হয়। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনষ্টিটিউট এসব পোনা লালন-পালন করে এর কৃত্রিম প্রজনন ও চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবনে সক্ষম হয়। দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এই প্রযুক্তি। অতঃপর থাই পাঙ্গাস চাষ ও উৎপাদনে দেশে বিপ্লব ঘটে যায়। পাঙ্গাস এখন “গরিবের মাছ” হিসেবে পরিচিত। এরপরেও পাঙ্গাসের স্বাদ ও রঙ নিয়ে আরও গবেষণার দরকার আছে।
তেলাপিয়া মাছও আমাদের দেশে এখন কম জনপ্রিয় নয়। ষাটের দশকে টঘওঈঊঋ এর মাধ্যমে তেলাপিয়া মাছ আমাদের দেশে প্রথম আমদানি করা হয়। তখন এই মাছটির তেমন গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। তারপর এই মাছ নিয়ে শুরু হয় গবেষণা। এখন গিফট তেলাপিয়ার অনেক কদর। গিফট তেলাপিয়া থেকে তৈরি করা হয়েছে এর উন্নতজাত “বিএফআরআই সুপার তেলাপিয়া”। এর দৈহিক বৃদ্ধি আরও (৩০%) বেশি। অপরদিকে, মনোসেক্স তেলাপিয়ার এখন জয় জয়াকার। দেশব্যাপী ইতিমধ্যে ৫০টি মনোসেক্স তেলাপিয়ার হ্যাচারি বেসরকারিভাবে স্থাপন করা হয়েছে। বিক্রি হচ্ছে কোটি কোটি মনোসেক্স তেলাপিয়ার পোনা। তেলাপিয়ার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানভিত্তিক সাফল্যের এই স্বাদ চাষি এবং সাধারণ ভোক্তারা এখন ভোগ করছে। তথাপি তেলাপিয়া নিয়ে আমাদের আশংকাও কম নয়। বন্যা কবলিত এই দেশে তেলাপিয়া মাছ উন্মুক্ত জলাশয়ে ঢুকে জীববৈচিত্রের উপর কি ধরণের প্রভাব ফেলছে তা নিয়ে গবেষণা দরকার।
আমাদের দেশে বিদেশি মাছ চাষের বিপক্ষে আমার অবস্থান নয়।
বিদেশি মাছ চাষের পূর্বে এ নিয়ে আমাদের বি-র গবেষণার দরকার আছে; এটাই মূল কথা। আমদানিকৃত মাছ কোন রোগজীবাণু বহন করছে কি-না, এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কি রকম, খাদ্যাভ্যাস কি ইত্যাদি বিষয়ে গবেষণা করে চাষ উপযোগী মনে হলেই সম্প্রসারণে যাওয়া যুক্তিযুক্ত। অন্যথায় দেশের জলজ পরিবেশের জন্য তা ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তাই বিদেশি কোন মাছ দেশে আনার আগে সরকারি পর্যায় থেকে অনুমতি গ্রহণ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আমাদের কোয়ারেনটাইন ব্যবস্থা থাকা দরকার এবং তা কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন