লবণাক্ত ধানী জমিতে সারব্যবস্থাপনা
যে জমিতে চার ডিএস/মিটার বা এর অধিক মাত্রার লবণ থাকে কৃষিতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে তাকে লবণাক্ত মাটি বলে। বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় ১৩টি জেলায় (সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, ভোলা, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, ফেনী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার) ৮.৩০ লাখ হেক্টর আবাদি জমিতে বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততা রয়েছে, যা ফসল উৎপাদনে হুমকিস্বরূপ।
লবণাক্ত জমিতে কী ঘটেঃ মানুষের ক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের রোগীকে যেমন লবণ খেতে নিষেধ করা হয় এবং তার পরিবর্তে পটাশিয়ামসমৃদ্ধ খাবার (ডাবের পানি, কলা, গোল আলু) বেশি করে খেতে বলা হয়। সোডিয়ামসমৃদ্ধ লবণাক্ত জমির ক্ষেত্রেও কৃষি বিজ্ঞানীরা একই কথা বলে থাকেন। কেননা, অতিমাত্রায় সোডিয়াম লবণ থাকায় লবণাক্ত জমিতে গাছের স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয় এবং ফলন কমে যায়। সোডিয়াম লবণের এই বর্ধিত মাত্রাকে প্রতিরোধ করতে এবং মাটির অন্যান্য খাদ্যোপাদানকে গাছের জন্য খাবার উপযোগী করতে অধিক মাত্রায় পটাশিয়াম সরবরাহের প্রয়োজন হয়। লবণাক্ততার কুফল প্রতিরোধে এবং মাটির ভৌত গুণাবলি উন্নত করার জন্য জৈব সার ব্যবহারের আবশ্যকতা দেখা দেয়।
লবণাক্ত ধানী জমিতে সার ব্যবস্থাপনায় বিশেষজ্ঞের পরামর্শঃ প্রথমেই চাষি ভাইদের করণীয় হলো মাটি পরীক্ষা করে জমিতে সারের চাহিদা জেনে নেয়া। এ ক্ষেত্রে মৃত্তিকাসম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের মাঠপর্যায়ের অফিস থেকে সাহায্য নেয়া যেতে পারে। মাটি পরীক্ষাভিত্তিক রাসায়নিক সারের এই নিরূপিত মাত্রার সাথে অতিরিক্ত ৫ টন/হেক্টর জৈব সার বা ধৈঞ্চাসার ব্যবহার করলে প্রায় ১ টন ফলন বেশি পাওয়া যাবে। কেননা জৈব সারের মতো ধৈঞ্চাসারে নাইট্রোজেনের পাশাপাশি যথেষ্ট ক্যালসিয়াম এবং পটাশিয়াম রয়েছে। ধৈঞ্চার এই দু’টি উপাদান লবণাক্ত মাটির অতিরিক্ত সোডিয়ামকে প্রশমিত করে খাদ্যোপাদানের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করে। ফলে ধানগাছের বাড়-বাড়তি ভালো হয় এবং ফলন বৃদ্ধি পায়। তাই জৈব ও রাসায়নিক সার সম্মিলিত ব্যবহার করলে ধানের ফলন বেশি পাওয়া যায়। অনুরূপভাবে ধানের পূর্ণ কুশি অবস্থা আসার আগেই যদি মাটি পরীক্ষাভিত্তিক সারের মাত্রার সাথে অতিরিক্ত ২০ কেজি হেক্টর পটাশিয়াম প্রয়োগ করা যায়, তবে জৈব-অজৈব সারের সমন্বয়ে প্রয়োগকৃত সারের চেয়েও বেশি ফলন পাওয়া যায়। এর কারণ হলো পটাশিয়ামসমৃদ্ধ রাসায়নিক সার থেকে অতি দ্রুত পটাশিয়াম লবণাক্ত মাটির সোডিয়ামের বাধাকে অতিক্রম করে গাছের ব্যবহার উপযোগী অবস্থায় আসে। ফলে ফলন বৃদ্ধি পায়।
চাষি ভাইদের আর্থিক দৈন্য এবং কৃষিজমির দুর্বল স্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে কৃষি বিজ্ঞানীরা উপকূলীয় লবণাক্ত জমির জন্য ছাই চিকিৎসার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কেননা ছাইতে যথেষ্ট পটাশিয়াম রয়েছে। তাই ছাই প্রয়োগে ছাইয়ের পটাশিয়াম লবণাক্ত মাটির সোডিয়ামকে প্রশমিত করে ভারসাম্য তৈরি করে এবং ধানের ফলন বৃদ্ধিতে সহায়তা করে।
বোরো মৌসুমে যে জমি লবণাক্ত (৮-৯ ডিস/মিটার) জমি আমন মৌসুমে জলমগ্ন হওয়াতে অলবণাক্ত (২-৩ ডিএস/মিটার) জমিতে পরিণত হয়। বৃষ্টির পানি বা সেচের মাধ্যমে মিষ্টি পানি জমিতে প্রবেশ করাতে পারলে লবণাক্ততা কমে গিয়ে তা স্বাভাবিক জমিতে পরিণত হওয়ায় মাটির সব খাদ্যোপাদানই ধানগাছ তখন সহজে গ্রহণ করতে পারে। তাই শুষ্ক মৌসুমে পর্যাপ্ত সেচ প্রদান করেও লবণাক্ত ধানী জমির সার ব্যবস্থাপনা করা যায়।
আরমান হায়দার
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন